খে লার দুনিয়ায় একটি নিয়ম প্রচলিত: নেহাত অনিবার্য কারণ না থাকিলে কোনও অধিনায়ক ‘উইনিং কম্বিনেশন’ ভাঙিতে চাহেন না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নূতন মন্ত্রিসভা সম্বন্ধেও একই কথা বলা চলে। মণীশ গুপ্তের ন্যায় দক্ষ এক জন মন্ত্রী চোটের কারণে আপাতত মাঠের বাহিরে চলিয়া গিয়াছেন। তাহা ব্যতীত, গত বারের প্রধান খেলোয়াড়রা অপরিবর্তিত। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের অধিকাংশের দফতরও কার্যত অপরিবর্তিত। কেহ বলিতে পারেন, আরও ভাল মন্ত্রিসভা সম্ভব ছিল। কথাটি ভুল নহে— ভালর শেষ নাই। কিন্তু, মন্ত্রিসভা গঠনের পিছনে ধর্ম, বর্ণ, অঞ্চলের যে বিবিধ সমীকরণগুলি সমাধান করিতে হয়, তাহার কথা বিস্মৃত না হওয়াও ভাল। সেই হিসাব ধরিলে বলিতে হয়, অনেকটাই হইয়াছে। মন্ত্রিসভার আয়তন অবশ্য কম নহে— বিধিবদ্ধ সর্বোচ্চ সীমার কাছাকাছিই। অনুমান করা চলে, সংগঠনে গুরুত্ব, বিশেষ গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব ইত্যাদির কারণে কলেবর বাড়িয়াছে। মুখ্যমন্ত্রী শপথ লইয়া জানাইয়াছেন, বাংলাকে জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন দেওয়াই তাঁহার উদ্দেশ্য। সেই লক্ষ্যে পৌঁছাইতে গেলে একটিই মন্ত্র: ‘ন্যূনতম সরকার, সর্বোত্তম প্রশাসন’— নরেন্দ্র মোদী যে মন্ত্রটি বহু বার উচ্চারণ করিয়াও এই দুই বৎসরে বাস্তবায়িত করিতে পারেন নাই। মন্ত্রিসভার আয়তনকে ন্যূনতম বলিবার উপায় নাই। অতঃপর প্রকৃষ্ট শাসনের ব্যবস্থাটুকু করিতে পারিলেও যথেষ্ট হয়।
যে মন্ত্রিসভায় সাড়ে তিন ডজন মন্ত্রী আছেন, সেখানেও কেন মুখ্যমন্ত্রীর হাতে আটটি দফতরের দায়িত্ব রাখিতে হয়, এই প্রশ্নটি কেহ করিতেই পারেন। বিশেষত, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণের ন্যায় একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ দফতর কেন তাঁহাকে নিজের কাছেই রাখিতে হইল? তিনি এই সরকারের প্রধান, ফলে সব দফতরই তাঁহার অধীন। অতএব, তাঁহার হাতে থাকা দফতরগুলির ভার অন্য কোনও যোগ্য মন্ত্রীর হাতে তুলিয়া দিলেও তিনি নিয়ন্ত্রণ হারাইতেন না। কিন্তু, দফতরগুলি সম্ভবত তুলনায় বেশি মনোযোগ পাইত, তিনি নিজেও সামগ্রিক পরিচালনায় মনোনিবেশ করিতে পারিতেন। প্রসঙ্গত, কলিকাতা পুরসভার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ও এই মন্ত্রিসভায় গুরুদায়িত্ব পাইয়াছেন। মেয়রের দায়িত্বটিও লঘু নহে। একই সঙ্গে দুইটি দায়িত্ব পালন করা তাঁহার পক্ষে সম্ভব হইবে কি? না কি, দলনেত্রী পুরসভায় নূতন মুখ আনিবেন? প্রশ্ন থাকিতেছে। তবে, বিশেষত তৃণমূল কংগ্রেসের ন্যায় দলের মন্ত্রিসভায় নেত্রীর আস্থাভাজনরা ঠাঁই পাইলে কাজের গতি ও কুশলতা বাড়িবার সম্ভাবনা, ঠিকই।
নির্বাচনের প্রচারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলিয়াছিলেন, রাজ্যের ২৯৪টি আসনে তিনিই প্রার্থী। প্রকৃত প্রস্তাবে, মন্ত্রিসভাতেও তাহাই। অতএব, তিনি ঠিক কোন পথে রাজ্যকে চালাইতে চাহেন, তাহা গোড়াতেই স্পষ্ট করিয়া দিন। কোন দফতরের নিকট তাঁহার কী প্রত্যাশা, মন্ত্রীদের জানাইয়া দিন। এবং, প্রথম দিন হইতেই সেই অভিমুখে চলুন। তিনি স্বয়ং জানাইয়াছেন, এই দফায় তাঁহার প্রধান উদ্দেশ্য কর্মসংস্থান। তাহার জন্য বিনিয়োগ প্রয়োজন। অমিত মিত্র যে হিসাবই পেশ করুন না কেন, সরকারের গত দফায় রাজ্যে বিনিয়োগ আসে নাই। অনুদানই একমাত্র নীতি হইলে এই দফাতেও আসিবে না বলিয়াই আশঙ্কা। মুখ্যমন্ত্রী গোড়াতেই অনুদান ও প্রকৃত উন্নয়নের দুধ-জল আলাদা করিয়া দিন। অনুদানের জল থাকিবেই, কিন্তু উন্নয়নের দুধও যেন থাকে, মন্ত্রীদের সে বিষয়ে সতর্ক করিয়া দিন। রাজ্যের শিল্পায়নের স্বার্থে কোন দফতরের কী কর্তব্য, মুখ্যমন্ত্রী স্থির করিয়া দিন, ও নির্দিষ্ট সময় অন্তর সেই হিসাব নিন। প্রথম দফায় যাহা হয় নাই, দ্বিতীয় দফায় হউক।