প ঞ্জাবের গুরদাসপুরের ঘটনা আকস্মিক, কিন্তু তাহাকে অ-প্রত্যাশিত বলা চলে না। ঈশান কোণে সিঁদুরে মেঘের ইশারা ছিলই। প্রতি বার যখন ভারত ও পাকিস্তান সদর্থক মেজাজে আলোচনা-বৈঠকের জন্য প্রস্তুত হয়, তখনই ভয়ানক জঙ্গি আঘাতে ভারতকে কাঁপিয়া উঠিতে হয়। আলোচনার পরিবেশ ধ্বস্ত হয়। এক পা অগ্রসর হইবার বদলে আবারও দুই পা পশ্চাদপসরণ করিতে হয়। এ বারও দুই দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের বৈঠক কাছে আসিতেই গুরদাসপুর-কাণ্ড ঘটিতে হইল। চলতি মাসের গোড়ায় রাশিয়ার ‘উফা’য় পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সহিত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর একান্ত আলাপের পর হইতেই দুই দেশের মধ্যে একটি মৈত্রীর স্বর চলাচল করিতেছিল। মুখোমুখি বৈঠকের তোড়জোড় চলিতেছিল। বাস্তবিক, দুই দেশের সম্পর্কে বিরাট কিছু ঘটিতে চলিয়াছে, এমন একটি প্রবল আশাময়তা এনডিএ সরকারের আনাচকানাচে ধ্বনিত হইতেছিল। মোদীর পাক নীতিই অসম্ভবকে সম্ভব করিতে চলিয়াছে, এই মর্মে রাজনৈতিক প্রচারও শুরু হইয়াছিল। না আঁচাইতেই উৎসাহবন্যা বওয়াইবার বোকামির পর গোটা বিজেপি শিবির এই মুহূর্তে প্রতিহিংসায় ফুঁসিতেছে। আলোচনার প্রস্তাবকে শিকায় তুলিয়া পাকিস্তানকে আচ্ছা শিক্ষা দিবার কথা বলিতেছে। অত্যুৎসাহেরই অপর পিঠ অতি-হতাশা। বিজেপির নিজস্ব জাতীয়তাবাদের প্রচার এই পেন্ডুলাম দোলনে বলীয়ান হইতে পারে। কিন্তু এক শত আশি ডিগ্রি ঘুরিয়া আবার নূতন করিয়া পাকিস্তান-নিন্দায় ডুবিয়া আলোচনার পথ বন্ধ করিয়া দিলে জাতীয়তাবাদের বাজার গরম হইলেও ভারতের কূটনৈতিক স্বার্থটি কতখানি সিদ্ধ হইবে, তাহা গুরুতর প্রশ্ন।
স্পষ্টতই, সীমান্তের অপর পারে যাঁহারা সন্ত্রাসের সময়সূচি নির্ধারিত করেন, তাঁহাদের উদ্দেশ্য দুই দেশের সুসম্পর্কের সম্ভাবনা বানচাল করা। ভারতে কট্টর জাতীয়তাবাদীদের আবেগ উশকাইয়া সেই উদ্দেশ্য সাধন অতীব সহজ। ইহার প্রয়োজনীয়তাও বোঝা কঠিন নয়। পাকিস্তানের মতো আত্মপরিচয়-সংকটে দীর্ণ রাষ্ট্রের কাছে ভারত-বন্ধুত্ব অপেক্ষা ভারত-বিরোধিতার বাস্তবটি অবশ্যই বেশি উপযোগী। আর্থ-সামাজিক অশান্তিতে জর্জরিত দেশটি নাগরিক-সাধারণকে অনেকাংশে ভুলাইয়া রাখিতে পারে ভারত-বিরোধী জিগিরের সাহায্যে। সুতরাং পাক গোয়েন্দা বাহিনী কিংবা সামরিক বাহিনী যে এমন হামলার প্রধান সমর্থক, তাহা ভিত্তিহীন অনুমান নয়। তাহা সত্ত্বেও কেন মাঝে মাঝেই নওয়াজ শরিফরা আলোচনায় উৎসাহী হইয়া উঠেন? ছলনা? না কি সত্যই সে দেশে শুভ ও অশুভের শুম্ভনিশুম্ভ লড়াই চলে? কখনও এই দল জিতে, কখনও ওই দল?
নিঃসংশয়ে বলা কঠিন। অনুমান, সন্ত্রাসীরা কেবল ভারতকেই তাঁহাদের আঘাতের লক্ষ্য করেন না, পাকিস্তানের একাংশকেও করেন, মৈত্রীর দৌত্যকে নিঃশেষ করাই তাঁহাদের অভীষ্ট। পাকিস্তানের অভ্যন্তরের ঘটনাবলি তাহার সর্বাপেক্ষা বড় প্রমাণ। মনে রাখিতে হইবে, গুরদাসপুর ভারতে বাৎসরিক বাস্তব, কিন্তু পাকিস্তানে— আক্ষরিক ভাবেই— প্রাত্যহিক বাস্তব। একের পর এক হামলায় সে দেশে নাগরিকরা প্রাণ হারান, অবিরাম রক্ত ঝরে। ফিদাঁয়ি জঙ্গিরা এই সব ক্ষেত্রে কাহাকে লক্ষ্য ঠাওরাইতেছে, ভাবিতে হইবে বই কী। সে ক্ষেত্রে ভারতের কর্তব্য কী? আলোচনা বন্ধ করিয়া গরম হুঙ্কারে গোটা পাকিস্তানকেই এক সুরে শত্রু ঘোষণা করা? জঙ্গি লক্ষ্যটিকেই সার্থক করা? না কি আলোচনার ক্ষেত্রটি রক্ষা করিয়া পাকিস্তানের একাংশের সহিত হাত মিলাইয়া জঙ্গি হানার উদ্দেশ্যটি ব্যর্থ করা? মোদীর দল ও সরকার কোন পথ লইবেন, তাহা ক্ষুদ্র স্বার্থের প্রশ্ন। কিন্তু দেশের বৃহৎ স্বার্থ কোন পথ চাহে, তাহা পরিষ্কার।