সম্পাদকীয় ১...

প্রস্থান ও প্রবেশ

২০১১-উত্তর সিপিআইএম-কে দেখিলে যাদব চক্রবর্তীও বিলক্ষণ অবাক হইতেন। তাঁহার গণিত পুস্তকের যে চৌবাচ্চা যুগের পর যুগ ছাত্রদের দুঃস্বপ্নের কারণ ছিল, সেই চৌবাচ্চাতেও দুইটি নল থাকিত একটি নলে চৌবাচ্চা হইতে জল বাহির হইত এবং অন্যটির মাধ্যমে জল আসিত। সিপিআইএম-এর চৌবাচ্চাটিতে, দৃশ্যতই, দ্বিতীয় নলটি আর নাই। দল হইতে বহিষ্কারের রাস্তাটি অবশ্য খোলা আছে। বস্তুত, যে ভঙ্গিতে পার্টি রেজ্জাক মোল্লাকে বহিষ্কার করিল, তাহা চমকপ্রদই বটে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০১৪ ০৪:১১
Share:

২০১১-উত্তর সিপিআইএম-কে দেখিলে যাদব চক্রবর্তীও বিলক্ষণ অবাক হইতেন। তাঁহার গণিত পুস্তকের যে চৌবাচ্চা যুগের পর যুগ ছাত্রদের দুঃস্বপ্নের কারণ ছিল, সেই চৌবাচ্চাতেও দুইটি নল থাকিত একটি নলে চৌবাচ্চা হইতে জল বাহির হইত এবং অন্যটির মাধ্যমে জল আসিত। সিপিআইএম-এর চৌবাচ্চাটিতে, দৃশ্যতই, দ্বিতীয় নলটি আর নাই। দল হইতে বহিষ্কারের রাস্তাটি অবশ্য খোলা আছে। বস্তুত, যে ভঙ্গিতে পার্টি রেজ্জাক মোল্লাকে বহিষ্কার করিল, তাহা চমকপ্রদই বটে। দল এখন যেমন বেহাল, তাহাতে এই পদক্ষেপ অপ্রত্যাশিত ছিল বলিলে ভুল হইবে না। রেজ্জাক মোল্লার দাবিগুলির যাথার্থ্য অন্যত্র আলোচ্য, কিন্তু সম্পূর্ণ যথার্থ দাবি লইয়াও দলের শৃঙ্খলা ভাঙা দলের চক্ষে অপরাধ। দলের যখন ‘যৌবন’ ছিল, তখন এই ‘ঔদ্ধত্যের’ ভগ্নাংশমাত্র প্রকাশ করিয়াও পার পাওয়া নিতান্ত অসম্ভব হইত। কিন্তু, সে দিন গিয়াছে। ২০১৪ সালের ন্যুব্জ সিপিআইএম-এর পক্ষেও যে এই দৃঢ়তা অর্জন করা সম্ভব, তাহা হয়তো অনেকেই ভাবেন না। সম্ভবত রেজ্জাক মোল্লাও নহেন।

Advertisement

দলের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থে কাজটি সম্ভবত ভালই হইল। যে দলের আর কিছুই নাই, তাহাতে শৃঙ্খলাটুকুও যদি না থাকে, তবে ভবিষ্যতে হাতে পেনসিলও থাকিবে না। দল হইতে বহিষ্কৃত হইবার পর রেজ্জাক মোল্লা রাজনৈতিক ভাবে কতখানি বাঁচিয়া থাকেন, তাহার উপর অনেক কিছুই নির্ভর করিতেছে। যদি দেখা যায় যে এই মৃতপ্রায় সিপিআইএম হইতে বহিষ্কৃত হইয়াও তিনি নিজের রাজনৈতিক তাৎপর্য বাঁচাইয়া রাখিতে পারিলেন না, তবে দলের অনেকের নিকটই বার্তাটি পৌঁছাইবে। তাঁহারা বুঝিবেন, বিদ্রোহী হইলে তাহার ফল বিপজ্জনকও হইতে পারে। সিপিআইএম-এর অভ্যন্তরে কিছু অসুখী নেতা টিকিয়া থাকিলে তাহাতে দলের লাভ কী, সেই প্রশ্নের উত্তর আলিমুদ্দিন স্ট্রিট খুঁজিবে। কিন্তু, দলের ভাঙন ঠেকানো যদি গুরুত্বপূর্ণ হয়, তবে মোল্লাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্তটি ঠিক। সইফুদ্দিন চৌধুরীদের সহিত তাঁহার একটি পার্থক্য অনস্বীকার্য সইফুদ্দিনরা সর্বশক্তিমান সিপিআইএম-এর বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করিয়াছিলেন। রেজ্জাক মোল্লা এক অন্য সিপিআইএম-এর উপর খাঁড়ার ঘা মারিতে উদ্যত হইয়াছিলেন। এই অন্য সিপিআইএম-এর দাম ঠিক কত, অদূর ভবিষ্যতে রেজ্জাক মোল্লার রাজনৈতিক জীবন উত্তর দিবে।

কিন্তু, সেই উত্তরে কাহার লাভ? দলের চৌবাচ্চায় জল ভরিবার নলটি তো নেতারা প্রাণপণে বন্ধ করিয়া রাখিয়াছেন। ১৯৭৭ হইতে ২০০৯ পর্যন্ত দীর্ঘ সময় জুড়িয়া যাঁহারা সিপিআইএম-এর ছত্রচ্ছায়ায় আসিয়াছিলেন, তাঁহাদের অধিকাংশই সম্ভবত আসিয়াছিলেন ক্ষমতার লোভে। সেই ক্ষমতা এখন অতীত। অদূর ভবিষ্যতে ফের আলিমুদ্দিনে ক্ষমতার নহবত বসিবে, সে সম্ভাবনাও কম। ফলে, এখন দলে লোক টানিতে হইলে কর্মসূচির জোরে টানিতে হইবে। এমন কথা বলিতে হইবে, তরুণ প্রজন্মের মনে যাহার অনুরণন সম্ভব। কেজরীবালের উদাহরণটি স্মর্তব্য। বস্তুত, যে দেশে অর্থনৈতিক অসাম্য ক্রমবর্ধমান, উন্নয়ন কর্মসূচি লইয়া যত রাজনীতি হয়, কাজের কাজ তাহার অংশমাত্রও হয় না সেই দেশের বামপন্থীরা রাজনৈতিক প্রশ্নের অভাবে ভুগিতেছেন ভাবিলে আশ্চর্য লাগে বইকী। কিন্তু, ইহাই বাস্তব। আলিমুদ্দিন স্ট্রিট অথবা এ কে গোপালন ভবনের কর্তারা এখনও ‘সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা’ অপেক্ষা প্রাসঙ্গিকতর কোনও প্রশ্নের কথা ভাবিতে পারেন নাই। তাঁহারা জোসেফ স্তালিনের ছবি বুকে ধরিয়া সুখে নিদ্রা যান, কিন্তু এই স্লোগানে উদ্বুদ্ধ হইয়া তরুণরা দলীয় কার্যালয়ে লাইন দিতেছেন, এমন স্বপ্ন দেখিবেন না যেন। বরং ভাবুন, চৌবাচ্চায় জল ভরিবার নলটি বন্ধ থাকিলে অবশিষ্ট জলটি বাহির হইতে কত সময় লাগিবে, সেই হিসাবটি তাঁহারা কীসে চাহেন ত্রৈরাশিকে, নাকি ভগ্নাংশে?

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন