প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে দেবগৌড়াকে সরিয়ে কংগ্রেস যখন ইন্দ্রকুমার গুজরালকে এই পদে বসানোর প্রস্তাব দিল, তখন জ্যোতি বসুর মতো নেতাও গুজরালকে ফোন করে আগাম অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।
সে সময়ে গুজরালের স্ত্রী কিন্তু তাঁকে বলেছিলেন, এ হেন জোট রাজনীতি, আর তার ভিত্তিতে জোট সরকার? এ সব কোনও দিন স্থায়ী হয় না কি? কী দরকার বাপু তোমার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার! শরীর খারাপ হয়ে যাবে। ইন্দ্রকুমার গুজরাল তাঁর আত্মজীবনীতেই জোটযুগের এই অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও কী ভাবে প্রতি পদে তিনি বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। সে সব তো আজ ইতিহাস। প্রধানমন্ত্রী হতে না হতেই এক দিন প্রাতরাশ বৈঠক করে সীতারাম কেশরী সরাসরি তাঁকে জানিয়েই দেন, কংগ্রেস বেশি দিন যুক্তফ্রন্ট সরকারকে সমর্থন জুগিয়ে যেতে পারবে না। অতএব জোট যুগ যে স্থায়ী হবে না, সে কথা তো ক্ষমতাসীন হয়েই বুঝেছিলেন ইন্দ্রকুমার গুজরাল। জোট মানেই ভারতের রাজনীতিতে বলা হয়, খিচুড়ি। সেই খিচুড়ি মানে অস্থির এক বিপদের নাম।
অবনীন্দ্রনাথের আঁকা ‘ভারতমাতা’
ভারতের রাজনীতিতে তাই জোট মানেই অস্থিরতা। জোট মানেই রাজনৈতিক লণ্ডভণ্ড। ’৮৪ সালে শেষ বারের মতো রাজীব গাঁধীর নেতৃত্বে একদলীয় সরকার গঠন হয়েছিল, তার পর ২০১৪-য় নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে আবার এল এক একদলীয় শাসন যাকে বলা হত ব্রুট মেজরিটি। ৩০ বছর পর ভারতীয় রাজনীতিতে এই যে নরেন্দ্র মোদীর হাত ধরে শাসন এল তা দেখে এক দিকে যেমন এটা স্পষ্ট যে ইন্দ্রকুমার গুজরালের স্ত্রীর আশঙ্কা করার মতো পরিস্থিতি এ যুগে আর নেই। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এ প্রশ্নও থেকে যাচ্ছে যে এই একদলীয় শাসনই কি তা হলে ভারতের রাজনীতিতে এক নতুন সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার দিকে দেশকে নিয়ে যাচ্ছে?
নরেন্দ্র মোদী নিজে হ্যাটট্রিক করা মুখ্যমন্ত্রী। এর আগে নরসিংহ রাও ব্যতিরেকে কোনও মুখ্যমন্ত্রীই প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হতে সক্ষম হননি। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নিজে প্রথমে এক আঞ্চলিক মসিহা হয়ে ওঠেন, তার পর ধাপে ধাপে তিনি এক সর্বভারতীয় নেতা হিসেবে নিজেকে উত্থিত করেছেন। স্বীকৃতি অর্জন করেছেন শুধু হিন্দুত্ববাদী দলীয় কর্মীদের কাছ থেকেই নয়, উন্নয়নকামী আপামর ভারতবাসীর কাছ থেকেও। ’৪৭ সালের পর থেকে ’৬৭ সাল এই দু’দশকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস শতকরা ৪৫ ভাগ ভোট পেয়েও লোকসভা আসনের শতকরা ৭০ ভাগ দখল করে রেখেছিল। কিন্তু রজনী কোঠারি বর্ণিত সে দিনের একদলীয় আধিপত্যের নেহরু যুগেও কিন্তু বিধান রায় থেকে কামরাজ, বিজুবাবু থেকে দাদা সাহিব পাটিল— নানা জনপ্রিয় আঞ্চলিক কংগ্রেস নেতাও একই ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন।
’৬৭ সালের পর থেকে কংগ্রেসের অবক্ষয় শুরু হয়। ৯টি রাজ্যে অকংগ্রেসি সরকার স্থাপিত হয়। দলের হাইকম্যান্ড নামক এক নতুন প্রাণীর জন্ম হয় ইন্দিরা যুগে। দলের অভিজাততন্ত্র বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় গাঁধীজির অনেক কষ্টে তৈরি করা আমজনতার সংগঠিত কংগ্রেসের মঞ্চ থেকে। তামিলনাড়ুতে তো ক্ষত এতটাই হয় যে ’৬৭ সালের পর থেকে আজ পর্যন্ত সে রাজ্যে কংগ্রেস আর ক্ষমতাতেই আসীন হতে পারেনি।
সময় বহতা স্রোত। সময়ের হাত ধরেই রাজনীতি বদলায় নিজস্ব নিয়মে। ব্যক্তি অনেক সময়েই চালিকাশক্তি হয়। তবে ইতিহাস-বিজ্ঞানীরা মনে করেন ’৯০-এর দশকে আর্থিক উদারবাদ ছিল সময়ের দাবি, তাই নরসিংহ রাও-মনমোহন সিংহ না থাকলেও ইতিহাস অন্য কাউকে ঠিক খুঁজে নিতই। যেমন, ১৯১৭ সালে বলশেভিক আন্দোলন ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনকে খুঁজে নিয়েছিল। ২০১৪ সালে ভারতের রাজনীতি আবিষ্কার করেছে নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীকে।
আবার এসেছে একদলীয় শাসন। ত্রিশ বছর পর। বিজেপির মতো দলের পক্ষে এই প্রথম এত বড় প্রাপ্তিযোগ। কিন্তু ইতিহাস আসলে পিছনের দিকে হাঁটে না। বোধহয় তার গতি সর্পিলাকার (স্পাইরাল), সরলরেখার মতোও নয়। মোদী নিজে মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তাই তিনি জানেন রাজ্য সরকারের বেদনা। কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের ফাটলগুলি কোথায়। আর তাই মোদীর ব্যক্তিমাহাত্ম্য কীর্তনের পাশাপাশি মোদী ও তাঁর সেনাপতিদের মুখ থেকে বার বার শোনা যাচ্ছে সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রের কথা।
রক্ত যদি শুধু হৃদপিণ্ডে জমা হয়, তা যদি গোটা শরীরে সংবহন না হয়, তা হলে মানুষ বাঁচতে পারে না। তেমনই ‘নেশন’ ‘নেশন’ করে যতই চিল চিৎকার আমরা করি না কেন, শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠন তখনই সম্ভব যখন রাজ্যগুলিও শক্তিশালী হবে। দুর্বল রাজ্যগুলিকে নিয়ে শক্তিশালী মহাজাতি গঠন আসলে এক বিরাট ফ্যালাসি। মোদী-যুগ ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সেই ভ্রান্তি থেকে মুক্তির পথ খুঁজছে।
উপ-রাষ্ট্র (sub-state) জাতীয়তার পরিচিত সমস্যা ভারতের রাজনীতিতে নতুন নয়। খলিস্তান থেকে তেলঙ্গানা, কত আন্দোলনের সাক্ষী আমরা। ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য ভাগে বিসমিল্লায় গলদ ছিল এমন সমালোচনাও অনেকে করেন। কিন্তু সময়ের বাধ্যবাধকতা মেনে আপাতত কেন্দ্রীভূত শাসনের পরিবর্তে আসলে অনেক বেশি ক্ষমতা রাজ্যের স্বশাসনেও দিতে হবে। কেননা, যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারত গঠন সমস্যা শুধু রাজনীতি নয়, অর্থনীতির সঙ্গেও গভীর ভাবে যুক্ত। আর্থিক বিকেন্দ্রীকরণের সমস্যা আজ জটিল হয়ে রয়েছে। এই জটিলতা নিরসন প্রয়োজন। আর্থিক বঞ্চনার দীর্ঘ ট্র্যাডিশনের অবসানের প্রয়োজন। সারকারিয়া কমিশনের মতো আর একটি নতুন কমিশন গঠন করলেই সে সমস্যার সমাধান হবে না। পরিবর্তন চাই দিল্লির মসনদি মানসিকতার। হাইকম্যান্ড নামক এক জুজুর মাধ্যমে আঞ্চলিক নেতাদের খর্ব থেকে খর্বতর করলে চলবে না, তাদের মুক্ত আকাশে প্রাণ ভরে নিশ্বাস নেওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে।
ভারতের রাজ্যগুলির মধ্যেও আছে অসম বিকাশের সমস্যা। পঞ্জাবে পুঁজিবাদের অতি-বিকাশ সেখানে খলিস্তানি বিচ্ছিন্নতার জন্ম দেয়, আবার ঝাড়খণ্ডের মানুষের সামন্ততান্ত্রিক বিচ্ছিন্নতা আদিবাসী সমাজকে মাওবাদী পথে ঠেলে দেয়। এই অসম বিকাশ দূর করার জন্য প্রতিটি রাজ্যের মধ্যে চাই এক গতিশীল আদান-প্রদানের পদ্ধতি। একটি রাজ্য তার অভিজ্ঞতা, তার মেধা অন্য রাজ্যকে জানাবে। মুখ্যমন্ত্রীদের মধ্যে রাজনীতি নিরপেক্ষ ভাবে আলোচনার পরিবেশ গড়ে উঠবে, সেটাই কাম্য। এই কাজটিও বাস্তবায়িত করার জন্য ৭ নম্বর রেসকোর্স রোডে এক শক্তিশালী রাজনৈতিক কর্তৃত্বের প্রয়োজন ছিল। মোদীর মতো তথাকথিত স্ট্রংম্যান ক্ষমতাসীন হওয়ায় তাই এই আশা সঞ্চারিত হয়েছে। এ বারে রাজ্যগুলির মধ্যে অভ্যন্তরীণ সংযোগ বাড়বে।
তবে রাজ্যগুলির সুষ্ঠু সমন্বয় ও শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনের তাগিদে কেন্দ্র যেন দাদগিরির ভূমিকায় অবতীর্ণ না হয়। লাতিন আমেরিকায় যে ভাবে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ দেখা যায়, তা নৈব নৈব চ। কেন্দ্রের ভূমিকা হবে এক প্রোমোটারের, অ্যাসেসরের। গোটা প্রক্রিয়াকে মোদী সরকার নিয়ন্ত্রণ করলেও কেন্দ্রের ভূমিকা হবে পরিষেবা প্রদানকারীর। অতীতে কেন্দ্র-রাজ্যের ক্ষমতার বিন্যাসে এই লক্ষণ রেখা বারবার ভূলুন্ঠিত হয়েছে।
খিচুড়ি সরকারের জোট যুগকে অনেকেই মনে করতে শুরু করেছিলেন যে এ দেশের রাজনীতিতে গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য হয়তো এই জোট-যুগ ভাল। নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধানের ভারত হারাতে বসেছিল তার বহুত্ববাদ, একদলীয় শাসনের হিটলারি-মননে। কিন্তু এখন মূল প্রশ্ন, এক দিকে মোদীর হাত ধরে ফিরে এসেছে একদলীয় শাসন, অন্য দিকে, সময়ের দাবি সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয়তা। কিন্তু এই দুই প্রবণতার মধ্যে কি কোনও স্ববিরোধ আছে?
নরেন্দ্র মোদীর সামনে আপাতত সেটাই চ্যালেঞ্জ, কী ভাবে রাজ্যের স্বাধিকার বৃদ্ধি, আঞ্চলিক পরিচয় সত্তাকে স্বীকার করার মাধ্যমে এক শক্তিশালী মহাজাতি গঠন সম্ভব? মোদী সরকার গঠনের এক মাসও হয়নি। সন্তানের ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী হওয়াই তো দস্তুর। কাম্যও।