প্রিয়ঙ্কা চোপড়ার লাস্য চিত্তাকর্ষক, সন্দেহ নাই। কিন্তু, তাহাতে ভারতীয় ফুটবলের উন্নতির সম্ভাবনা মঙ্গলগ্রহে প্রাণের সন্ধান পাইবার সম্ভাবনার তুলনায় খুব বেশি নহে। যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে যাঁহারা ইন্ডিয়ান সুপার লিগের উদ্বোধনী আসরে ভিড় জমাইয়াছিলেন, তাঁহাদের টানিয়াছিল বলিউড-বিনোদন। আইএসএল নামক প্রতিযোগিতাটির মূল উদ্দেশ্য যদি আরও একটি গ্ল্যামারমণ্ডিত বিনোদনবাসর নির্মাণ হয়, তবে ভিন্ন কথা। কিন্তু, ভারতীয় ফুটবলের উন্নতিসাধন ইত্যাদির কথা বলিলে ইহা পথ নহে। খেলোয়াড়-জীবনের সায়াহ্নে উপনীত কিছু খ্যাতনামা বিদেশি ফুটবলারকে আনিয়া, তাহাতে বলিউড ও ক্রিকেটের দ্যুতির প্রতিফলন ঘটাইয়া ভারতের ফুটবলের উন্নতি হইবে না। তাহার জন্য একেবারে নিচুতলায় মন দিতে হইবে। সেই কাজটি বাজারের হাতে ছাড়িয়া দিলে হয় না। তাহার জন্য প্রতিযোগিতার দায়িত্বটি সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের হাতে থাকাই বিধেয় ছিল।
কেহ বলিতেই পারেন, আইএসএল-এ দল কিনিবার পূর্বশর্ত স্থানীয় ফুটবলের উন্নতিকল্পে অর্থব্যয়ের সম্মতি। সেই টাকা খরচ হইলে নূতন ফুটবলার পাওয়া যাইবে না কেন? এই প্রশ্নের জবাব অর্থনীতির স্নাতক স্তরের ছাত্ররাও জানিবেন। বেসরকারি বিনিয়োগ ব্যয়-লাভের অঙ্ক মানিয়া চলে। শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের ন্যায় ক্ষেত্রে সদর্থক অতিক্রিয়া বিপুল বিনিয়োগ হইতে প্রত্যক্ষ লাভের তুলনায় বৃহত্তর সামাজিক লাভের পরিমাণ অনেক বেশি। কাজেই, এই গোত্রের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ব্যয়-লাভের হিসাব মানিয়া ব্যয়ের অঙ্ক নির্ধারণ করিলে তাহা সামাজিক ভাবে যথেষ্ট হয় না। সেই কারণেই এই ক্ষেত্রগুলিতে এমন বিনিয়োগ প্রয়োজন, যাহা প্রত্যক্ষ এবং তাত্ক্ষণিক লাভ-ক্ষতির হিসাব কষে না। বাণিজ্যিক ক্লাবগুলি সে রকম সংস্থা নহে। দায়িত্বটি ছিল ফুটবল ফেডারেশনের। তাহারা টাকা গনিয়া লইয়া দায়িত্ব ঝাড়িয়া ফেলিয়াছে। অথচ, সুযোগ ছিল। ফুটবলে টাকা আসুক, বিদেশি খেলোয়াড়ও। খেলাটি দেশের বাণিজ্যিক ক্রীড়া মানচিত্রে স্থান পাক। কিন্তু, তাহা হউক ফুটবল ফেডারেশনের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। তাহাতে উন্নত মানের খেলোয়াড় তৈরি হইত, ভারতীয় ফুটবলের মানও বাড়িত। বস্তুত, পথটি ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’-র। বিশ্বের বিনিয়োগ ভারতে আসিয়া ভারতীয় ফুটবলের উন্নতি করিলে তাহাই সর্বাপেক্ষা কাম্য।
আইএসএল-এর মডেলটি ক্রিকেটের ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের অনুসারী। ফলে, আইপিএল-এর ভ্রান্তিগুলি আইএসএল-এও ঢুকিয়া পড়িয়াছে। আইপিএল ভারতীয় ক্রিকেটের উন্নতিতে কতখানি ভূমিকা লইয়াছে? আইপিএল-পন্থীরা কিছু ক্রিকেটারের নামের তালিকা পেশ করিয়া বলিবেন, আইপিএল হইতেই তাঁহারা উঠিয়া আসিয়াছেন। আইপিএল না থাকিলে কি তাঁহারা ভারতীয় ক্রিকেটের মূলস্রোতে আসিতে পারিতেন না? সচিন তেন্ডুলকর, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় হইতে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি, কাহারও উত্থানে আইপিএল-এর প্রয়োজন হয় নাই। কাজেই, ভারতীয় ক্রিকেটে আইপিএল-এর প্রভাব বুঝিতে চাহিলে এই হিসাবটি মাথায় রাখিতে হইবে। ক্রিকেটের বাজার ভিন্ন। টাকা আছে, বাণিজ্যিক আনুকূল্য আছে। ক্রিকেটে যে সাফল্য অর্জন সম্ভব, ফুটবলে তাহা কল্পনাতীত। ফুটবলের ক্ষেত্রে এআইএফএফ-এর আরও অনেক প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকিলে তবেই ফল পাওয়া সম্ভব হইত।