সম্পাদকীয় ১

বাজারের অধিকার

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের জন্য যে প্ল্যাটফর্মটি গড়িয়া উঠিয়াছিল, ইন্টারনেটের দুনিয়ায় অবাধ প্রবেশাধিকার না থাকিলে তাহা কি মাত্র দুই বৎসরের মধ্যে গোটা পৃথিবীতে ছড়াইয়া পড়িত? অবসর সময়ে মার্ক জুকেরবার্গ ভাবিয়া দেখিতে পারেন। উত্তরটি তিনি বিলক্ষণ জানিবেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:০০
Share:

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের জন্য যে প্ল্যাটফর্মটি গড়িয়া উঠিয়াছিল, ইন্টারনেটের দুনিয়ায় অবাধ প্রবেশাধিকার না থাকিলে তাহা কি মাত্র দুই বৎসরের মধ্যে গোটা পৃথিবীতে ছড়াইয়া পড়িত? অবসর সময়ে মার্ক জুকেরবার্গ ভাবিয়া দেখিতে পারেন। উত্তরটি তিনি বিলক্ষণ জানিবেন। যদি তাঁহার ফেসবুককে গ্রাহকের নিকট পৌঁছাইয়া দেওয়ার জন্য তাঁহাকে কোনও বৃহদায়তন সংস্থার সহিত— সেই সংস্থার চাপাইয়া দেওয়া শর্ত মানিয়া— চুক্তিবদ্ধ হইতে হইত, ক্যালিফোর্নিয়া হইতে কলিকাতা কি বাঁধা পড়িত ফেসবুকের সূত্রে? অন্তত, এত সহজে? ভাবিলে তিনিও ভারতের টেলিকম নিয়ন্ত্রক সংস্থা ট্রাই-এর সিদ্ধান্তটিকে স্বাগত জানাইবেন। বলিবেন, কোনও বিপুল সংস্থাকে অন্তর্জালের দুনিয়ায় ‘দেওয়াল ঘেরা বাগান’ তৈরি করিবার অধিকার দেওয়া উচিত নহে। বলিবেন, নূতনতর সংস্থা যাহাতে বিনা বাধায় এই দুনিয়ায় প্রবেশ করিতে পারে, তথ্য যাহাতে খণ্ডিত না হয়, তাহা নিশ্চিত করাই নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজ। ট্রাই সেই দায়িত্ব পালনে সফল হইয়াছে। তাহাতে যদি জনৈক মার্ক জুকেরবার্গের বিজ্ঞাপন বাবদ ৩০০ কোটি টাকা অপচয় হয়, সেই ক্ষতি বৃহত্তর এবং সামগ্রিক লাভের তুলনায় যৎসামান্য।

Advertisement

ট্রাই নেট নিরপেক্ষতার পক্ষেই রায় দেওয়ায় ভারতে অন্তর্জালের বাজারটি অখণ্ড থাকিল। ফেসবুকের ন্যায় আর্থিক পেশিসম্পন্ন কোনও সংস্থাকে সেই বাজারে দেওয়াল তুলিবার অধিকার দিলে তাহার প্রায় অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ছিল বাজারের উপর সংস্থার একচেটিয়া দখল। সেই দখল প্রতিষ্ঠা করিতে প্রাথমিক পর্যায়ে সংস্থার বিপুল অর্থব্যয় হইত। কিন্তু, ‘প্রিডেটরি প্রাইসিং’-এর মাধ্যমে এক বার বাজারটিকে প্রতিযোগী-মুক্ত করিতে পারিলে ভারতে অন্তর্জাল নিয়ন্ত্রিত হইত এই সংস্থার অঙ্গুলিনির্দেশে। অথবা, একই আয়তনের অন্য কোনও সংস্থার সহিত বাজারে একটি ওলিগোপলি বজায় থাকিত। সেই দখল তৈরি হইলে কোন সংস্থার পণ্য মানুষের নিকট পৌঁছাইবে, কোন খবর মানুষ পড়িবে আর কোনটি পড়িবে না, কী জানিবে আর কী জানিবে না, সবই এই সংস্থাগুলি নিয়ন্ত্রণ করিতে পারিত। তাহাতে প্রতিযোগিতার মারাত্মক ক্ষতি। নূতন কোনও সংস্থার পক্ষে এই সুউচ্চ প্রাচীর টপকাইয়া অন্তর্জালের দুনিয়ায় গ্রাহকের নিকট পৌঁছানো দুষ্কর হইত। অন্য দিকে, এক বার কোনও সংস্থার একচেটিয়া দখল প্রতিষ্ঠা হইলে সেই বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করাও নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষে কঠিন। তথ্যের অসাম্যের কারণেই কঠিন। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জঁ তিরোল যে ‘অপটিমাল কন্ট্রোল’-এর কথা বলিয়াছেন, তাহার মূল বার্তা হইল একচেটিয়া অধিকার কায়েম করিতে না দেওয়া। ট্রাই সেই কাজটি করিয়াছে। বাজার অর্থনীতির দর্শনের মূল কথা অবাধে প্রবেশের অধিকার।
ট্রাই-এর সিদ্ধান্তে সেই অধিকারটি রক্ষিত হইল।

নেট নিরপেক্ষতা প্রসঙ্গে ট্রাই জনমত চাহিয়াছিল। ফেসবুকের আক্রমণাত্মক কৌশলে ট্রাই নিজের বিরক্তি গোপন করে নাই। সংস্থার কর্তা বলিয়াছিলেন, জনমত চাওয়া আর গণভোট এক নহে। আশা করা যায়, কথাটি শেষ অবধি ট্রাই-এর স্মরণে থাকিয়াছে। নেট নিরপেক্ষতার প্রশ্নে দেশের বিভিন্ন শ্রেণির, বিভিন্ন স্বার্থের মানুষ কী ভাবিতেছেন, তাহা জানিতে চাওয়া ভাল। সেই মতের মধ্যে যেটুকু গ্রহণযোগ্য, তাহা গ্রহণ করাও উচিত। কিন্তু, প্রকৃত প্রস্তাবে প্রক্রিয়াটি গণতান্ত্রিক হইতে পারে না। সংখ্যাগরিষ্ঠের মত নহে, বরং বাজার অর্থনীতির দর্শনই এই প্রশ্নের উত্তরসন্ধানের চালিকাশক্তি। আশা করা যাউক, ট্রাইও সেই দর্শনের মূল সুরটিকেই মান্য করিয়াছে, প্রস্তাবের পক্ষে-বিপক্ষে ভোটের সংখ্যা নহে।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন