সম্প্রতি আনন্দবাজার পত্রিকায় পর পর কয়েকটি লেখা: প্রথমে অশোক মিত্রের সাক্ষাত্কার (‘আমাদের বামপন্থীরা...’, ১০-৬), তার পর পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সাক্ষাত্কার (‘বড় সাফল্যের পরে...’, ২৪-৬ এবং ‘রাজনীতির মানেটা...’, ২৫-৬), এবং অশোক বিশ্বনাথনের একটি লেখা (‘তিনি কিন্তু কখনও...’, ২৪-৬) পড়ে দু-চার কথা লিখতে ইচ্ছে করল।
পশ্চিমবঙ্গের সেই জ্যোতির্ময় যুগে অনিলায়িত শিক্ষাক্ষেত্রের চতুর্দিকে বহু বুদ্ধিজীবীকে ঘুরে বেড়াতে দেখতাম। এটা তো সর্বজনবিদিত যে, তাঁরা স্ব-স্ব ক্ষেত্রে যথেষ্ট লায়েক হয়েছিলেন বা হয়েছেন। বুদ্ধির শানিত প্রয়োগের মাধ্যমে জীবিকার স্থলটিতে নিজেদের আসন পাকাপোক্ত করে এই বুদ্ধিজীবীরা দেশ ও দশের যে প্রভূত উন্নতি সাধন করেছেন, এ কথা বহুলপরিচিত। ডাকসাইটে নেতারা এঁদের কাকু বা জেঠু ছিলেন। এবং সেই জেঠু বা কাকুদের ছেলেমেয়েদের কারও কারও টিউটরও ছিলেন এঁরা। কাকুরা তাঁদের স্নেহাস্পদদের যে নানাবিধ উচ্চ পদসমূহে অভিষিক্ত করবেন, তা কি বলার অপেক্ষা রাখে!
অতঃপর সেই দীর্ঘ জ্যোতির্ময় যুগের অবসানে যে নতুন যুগ আসে, সেই কালে বুদ্ধিজীবীরা প্রায় সকলেই ‘বুদ্ধজীবী’ হয়ে গেছিলেন। কালান্তরে তাঁরাই ‘ম-মতাদর্শী’ হয়ে নিজেদের আসন সংরক্ষিত রাখতে প্রয়াসী হলেন। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো এঁদেরই ‘নরেন্দ্রানুরাগী’ হতে দেখব।
মজার কথা এই, রাজনীতিতে মত ও দলের উত্থানপতন ঘটবে, শাসক ও শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটবে, কিন্তু বুদ্ধিজীবীরা সর্বদাই মহাপ্রসাদ খাবেন, লাল-নীল বাতিওয়ালা গাড়িতে চড়বেন, সরকারি পয়সায় নিজেদের অফিস ও বাংলো সাজাবেন এবং প্রৌঢ়ত্বে বা বার্ধক্যে পৌঁছেও বালকবালিকাসুলভ আচরণ করবেন, যেন তাঁরা ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানেন না।
প্রশ্ন জাগে, এঁরা কেমন বুদ্ধিজীবী? সুবুদ্ধিজীবী না দুর্বুদ্ধিজীবী? আমার মনে হয়, সময় এসেছে বুদ্ধিজীবীদের শ্রেণিবিভক্ত করার। যে সরকার বা রাজনৈতিক দল সরকারি কাজকর্ম সামলানোর জন্য অথবা দলভারী করার অভিপ্রায়ে বুদ্ধিজীবী নিয়োগে আগ্রহী, তাঁদের এই শ্রেণিবিভাগ করতে হবে, নচেত্ তাঁদের পতন অবশ্যম্ভাবী, যেমনটি হয়েছে বামপন্থী দলগুলির। তাঁরা সকলে এত বেশি বোদ্ধা যে আজ তাঁদের সঙ্গে কোনও যোদ্ধা নেই। কাকস্য পরিদেবনা ছাড়া এই পরিস্থিতিকে আর কী ভাবেই বা ব্যাখ্যা করা যায়!
অশোক বিশ্বনাথন জঁ লুক গোদারের ছবি সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘কুকুর কখনও উলঙ্গ নয়, কারণ সে সারাক্ষণই উলঙ্গ।’ মানুষের ক্ষেত্রে এটি একটু অন্য ভাবে বলা যায়, ‘কাপড়ের নীচে সকলেই উলঙ্গ’। আর উলঙ্গ যখন, তখন আবরণটির কথা না-ই বা মনে থাকল। বরং বুদ্ধিটা ঠিক মতো প্রয়োগ করলেই আচরণটিকে মায়া বা বিভ্রম বলে মনে হবে। আর মায়াই যখন, তখন সেটিকে কায়া থেকে একটু দূরে সরিয়ে ‘আখের-বাজি’ করাই ভাল। সত্যি কথা বলতে কী, দলমতনির্বিশেষে আখের রস সব সময়েই মিষ্টি; সময় মতো, সুযোগ মতো জার্সি বদলে বদলে যদি মিষ্টি পানীয় পাওয়া যায়, ক্ষতি কী! নিন্দুকেরা হয়তো তাতে বেহায়া বলবে। তা বলুক, ওইটুকু (লজ্জা-ঘৃণা-ভয়) উপেক্ষা না করলে কি আর বড় মাপের বুদ্ধিজীবী হওয়া যায়!
সাহেবদের কালে বঙ্গদেশের নবজাগরণ, ইংরেজি শিক্ষায় আলোকপ্রাপ্তি, ইত্যাদি ঘটনার ফলে বুদ্ধি যে ভাবে বিকশিত হল, মেরুদণ্ডটি তো সে ভাবে শক্তপোক্ত হয়নি। ইংরেজরা মেরুদণ্ড নির্মাণের শিক্ষাও আমাদের দিয়ে যায়নি। সুতরাং, ‘বুদ্ধির্যস্য বলং তস্য, নির্বুদ্ধেস্তু কুতো বলম্!’
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার। মতামত ব্যক্তিগত।