কখনও কখনও সমাধান সমস্যার অধিক ভয়ঙ্কর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দশটি রাজ্যে কলেজ ক্যাম্পাসে নিরাপত্তার স্বার্থে ছাত্রীদের বন্দুক রাখিবার অনুমতি দিতে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ চলিতেছে। উদ্যোগী জনপ্রতিনিধিরা মনে করেন, ছাত্রীদের নিকট বন্দুক রহিয়াছে জানিলে সম্ভাব্য আক্রমণকারীরা আর তাহাদের বিরক্ত করিতে সাহস করিবে না। এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে বিতর্কের ঝড় উঠিয়াছে। আপত্তি দ্বিবিধ: ব্যবহারিক ও নীতিগত। দুই আপত্তিই সংগত। মনে করিবার যথেষ্ট কারণ আছে যে, এই সিদ্ধান্ত বাস্তবে কার্যকর হইবে না। কারণ, তথ্য অনুযায়ী, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিচিত ব্যক্তি বা বন্ধুই মেয়েদের যৌন লাঞ্ছনা বা ধর্ষণ করিয়া থাকে। ফলে বন্দুক ব্যবহার করিয়া ভয় দেখাইবার বা আত্মরক্ষা করিবার অবকাশ থাকে না। বস্তুত, ইহাতে বিপরীত ফলের আশঙ্কাই প্রবল: মেয়েটির বন্দুক কাড়িয়া লইয়া তাহাকেই আঘাত করা আদৌ অসম্ভব নহে।
কিন্তু এই সমাধানে প্রবল নীতিগত আপত্তিও উঠিতে বাধ্য। প্রথমত, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। সেই দায়িত্ব এড়াইয়া ছাত্রীর হাতে আত্মরক্ষার্থে বন্দুক তুলিয়া দিলে কর্তৃপক্ষের দায়বোধ কাঠগড়ায় দাঁড়ায়। প্রশ্নটি কেবল ক্যাম্পাসেই প্রযোজ্য নয়, ইহার পরিধি অনেক বিস্তৃত। সমাধানের এই পথ অনুসরণ করিলে রাষ্ট্র প্রতিটি ব্যক্তির হাতে বন্দুক তুলিয়া দিতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রশ্নটির ঐতিহাসিক তাৎপর্য সুবিদিত, কারণ সে দেশে আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র রাখিবার অধিকার সংবিধানে নীতিগত ভাবে স্বীকৃত, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবসায়ীদের শক্তিশালী লবি এই অধিকার বাস্তবে প্রয়োগ করিতে সতত তৎপর। এই অধিকার মানিয়া লইলে কেবল হিংসার আশঙ্কা বাড়ে না, রাষ্ট্র তাহার নাগরিককে নিরাপত্তা দেওয়ার নৈতিক অবস্থান হইতে বিচ্যুত হইয়া যায়। অন্য ক্ষেত্রেও প্রশ্নটি উঠিতে পারে। যেমন মধ্যপ্রদেশে মাওবাদী আক্রমণ রোধ করিবার জন্য সরকার এক সময় গ্রামবাসীদের হাতে অস্ত্র তুলিয়া দিয়াছিল। সেই প্রকল্পও ছিল অনৈতিক। সরকার ক্রমশ তাহা হইতে সরিয়া আসে।
নৈতিকতার দ্বিতীয় প্রশ্ন: যে সমাজে কলেজ ক্যাম্পাসে মেয়েদের আত্মরক্ষার্থে বন্দুক সঙ্গে রাখিবার প্রস্তাব উত্থাপিত হয়, তাহা কেমন সমাজ? সেই সমাজে নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্ক সভ্যতার কোন স্তরে উন্নীত? সহপাঠী বা বন্ধুর মধ্যে যদি এই দুশ্চিন্তার আদানপ্রদান হয় যে, উহার নিকট বন্দুক রহিয়াছে, অতএব সাবধান, তাহা কি ব্যক্তিত্বের বিকাশের পক্ষে খুব সহায়ক? যে দেশে ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সর্বোচ্চ সম্মান দেওয়ার নীতি লইয়া সর্বদা গৌরব করা হয়, সেখানে কলেজের ভিতরে ছাত্রীদের আত্মরক্ষা লইয়া এমন বিড়ম্বনা! যে আইনপ্রণেতারা ছাত্রীদের আত্মরক্ষার স্বার্থে বন্দুক রাখিবার অনুমতি দিতে চাহেন, তাঁহাদের বরং ভাবিয়া দেখা উচিত, ছাত্রছাত্রীরা ব্যক্তিস্বাধীনতার যথার্থ ধারণা অর্জন করিতেছে কি না। যতক্ষণ না এক পক্ষ অন্য পক্ষের স্বাধীনতার শর্তগুলি মানিয়া লইতেছে এবং অন্যের উপর নিজের স্বাধীনতার যথেচ্ছ প্রয়োগকে অন্যায় বলিয়া উপলব্ধি করিতেছে, ততক্ষণ ব্যক্তিস্বাধীনতা যথেচ্ছাচারের শামিল, এবং তাহার ফলে যৌন আক্রমণের আশঙ্কা থাকিয়াই যাইবে। বস্তুত, অন্যের স্বাধীনতাকে সম্মান করিবার মানসিক অভ্যাসই মানবিক শিক্ষায় শিক্ষিত হইয়া উঠিবার প্রাথমিক শর্ত। মার্কিন জনপ্রতিনিধিরা এই বিষয়ে ভাবা অনুশীলন করিলে ভাল করিবেন।