মহারাষ্ট্রের রাজনীতি এ বার বাস্তবিকই ভোটের রাজনীতি। নির্বাচকরাই তাহার ভবিষ্যত্ নির্ধারণ করিবেন। অনুষ্ঠেয় বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে দুই প্রধান প্রতিপক্ষ শিব সেনা-বিজেপি এবং কংগ্রেস-এনসিপি-র জোট ভাঙিয়া গিয়াছে। এই জোট কেবল নির্বাচনী জোট ছিল না। উভয় জোটই পালা করিয়া রাজ্যের নির্বাচনে জয়ী হইয়া ক্ষমতাদখল করিয়াছে, রাজ্য শাসনও করিয়াছে। ইহার মধ্যে শিব সেনা-বিজেপির জোট পঁচিশ বছরের পুরানো, কংগ্রেস-এনসিপির জোট পনেরো বছরের। সুতরাং এ বারের নির্বাচন মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে এক পর্বান্তরের সূচক। যে প্রক্রিয়ায় জোট দুইটি ভাঙিয়াছে, তাহা এই পর্বান্তরের চরিত্র বুঝিবার পক্ষে বিশেষ সহায়ক।
শিব সেনা-বিজেপি জোটে শিব সেনার নেতা বালাসাহেব-তনয় উদ্ধব ঠাকরে মুখ্যমন্ত্রিত্বের দাবিদার হইয়া ওঠেন, সেই সূত্রে বাড়তি আসনও দাবি করেন। অথচ বিজেপির ধারণা হইয়াছে, মোদী-হাওয়া এখনও প্রবল, অন্তত মহারাষ্ট্রে সেই হাওয়া কাজে লাগাইয়া বিজেপি একার শক্তিতেই গরিষ্ঠতা বা বড় মাপের আধিপত্য অর্জন করিতে পারে। তাই শিব সেনার দাবির কাছে দল নত হয় নাই। অন্য দিকে কংগ্রেস-এনসিপি জোট প্রতিদ্বন্দ্বী জোটের অবস্থা কী দাঁড়ায়, সে জন্য অপেক্ষা করিতেছিল। আসন বণ্টন লইয়া সমস্যা এই জোটেও ছিল, প্রতি নির্বাচনের আগেই থাকে। কিন্তু কেন্দ্রে ইউপিএ সরকার ক্ষমতাসীন থাকাকালে কংগ্রেস হাইকমান্ড এনসিপি-র উপর যে জোর খাটাইতে পারিত, লোকসভায় মাত্র ৪৪টি আসন লইয়া তাহা সম্ভব নহে। উচ্চাকাঙ্ক্ষী আঞ্চলিক দল এনসিপি নেতৃত্বের পক্ষে তাই দরাদরির যুক্তি ক্রমে জোরালো হয়, পরিণামে জোটও ভাঙিয়া যায়। অতঃপর, চতুর্মুখী প্রতিদ্বন্দ্ব।
এই বিভাজন মহারাষ্ট্রের রাজনীতির অন্তর্নিহিত বিভাজনেরই পরিণাম। তাহা স্বাভাবিক বিভাজন, তাহার মধ্যে রাজনীতির ভগ্নাংশকরণের ভূত দেখার কোনও কারণ নাই। লক্ষণীয়, দুই সদ্যবিভক্ত জোটই ছিল একটি সর্বভারতীয় দলের সহিত একটি আঞ্চলিক দলের। চতুর্মুখী লড়াইয়ে আঞ্চলিক দল বনাম সর্বভারতীয় দলের প্রশ্নটি অনিবার্য ভাবে গুরুতর আকার ধারণ করিবে। প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনে প্রাদেশিক তথা আঞ্চলিক শক্তিগুলির ভাল ফলের সম্ভাবনা লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় প্রবলতর হয়। শিবসেনা এবং এনসিপি তাহা অবশ্যই মনে রাখিয়াছে, কংগ্রেস এবং বিজেপিও ভোলে নাই। প্রায়শ এই ধরনের আঞ্চলিক দলের পিঠে চড়িয়াই জাতীয় দলগুলি তাহাদের ‘জাতীয়’ চরিত্র রক্ষা করিতে পারে, আর সেই সূত্রেই বৃহত্ দলগুলির নেতৃত্বের মনে ‘সর্বভারতীয়তা’র একটা বিভ্রমও সৃষ্টি হয়। ভারতীয় জনতা পার্টির নির্বাচনী অঙ্কে সর্বভারতীয়তার অভিমান কতটা প্রভাব ফেলিয়াছে, ভোটের ফলই তাহা বুঝাইয়া দিবে। মহারাষ্ট্রীয় জাতীয়তার মঞ্চে শিবসেনা এখন আর একক নহে, রাজ ঠাকরের মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা তাহার প্রতিদ্বন্দ্বী, নূতন পরিস্থিতিতে সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার গুরুত্ব অবশ্যই বাড়িয়াছে। কিন্তু এই খণ্ডজাতীয়তা কয়েকটি অঞ্চলের সীমা অতিক্রম করিয়া বৃহত্তর রাজ্য রাজনীতিতে কতটা প্রভাব বিস্তার করিতে পারিবে, তাহা কেবল বিজেপির ভাগ্যনির্ধারণে নয়, সামগ্রিক ভাবেও একটি বড় প্রশ্ন। অন্য দিকে, কংগ্রেসের পক্ষে খেলা অতিমাত্রায় কঠিন। তাহার সর্বভারতীয় হাল ভয়াবহ, আবার রাজ্য স্তরেও দীর্ঘ জোটশাসনের দায় হইতে এত সত্বর ভোটদাতারা তাহাকে মুক্তি দিবেন না। কিন্তু এই জটিল ও বহুমাত্রিক প্রতিযোগিতার মধ্য হইতে মহারাষ্ট্রে যে ফলই প্রকাশিত হউক, তাহা হইবে গণতন্ত্রের জনাদেশ। কঠিন অঙ্কটি কষিবার ভার জনসাধারণের হাতেই ন্যস্ত হইয়াছে। সেখানেই এ বারের নির্বাচনের বিশেষ তাত্পর্য।