সোনালি গুহ সকল তিরস্কারের অতীত। সীমাজ্ঞান তাঁহার কখনও ছিল না। রাজনীতির পাদপ্রদীপের আলোয় থাকিতে জঙ্গিপনাই তাঁহার একমাত্র অস্ত্র। কয়েক মাস পূর্বেই তিনি নিজেকে ‘সরকার’ ঘোষণা করিয়াছিলেন। কিন্তু, মেয়ো রোডের জনসভায় তিনি সূর্যকান্ত মিশ্র সম্বন্ধে যে উক্তি করিলেন, তাহা সোনালি গুহ-র মাপকাঠিতেও অভূতপূর্ব। তবে, অপ্রত্যাশিত কি? তিনি অভিজ্ঞতায় শিখিয়াছেন, তাঁহার দলে অশালীন উক্তি, ঔদ্ধত্য বা আইনলঙ্ঘন, কিছুরই শাস্তি হয় না। রাতদুপুরে লোকের বাড়িতে হামলা করিয়াও তাঁহার উপর শাস্তির খাঁড়া নামে নাই। অনুব্রত মণ্ডল, তাপস পালরাও যথাপূর্বম্ থাকিয়া গিয়াছেন। কাজেই, বিরোধী দলনেতা সম্বন্ধে উক্তি করিবার সময় শালীনতার সব সীমা অতিক্রম করিতে সোনালি ভয় পান নাই। পুরস্কারের আশা করিয়াছিলেন কি না, সেই প্রশ্নেই বরং জল্পনা চলিতে পারে।
সোনালি গুহদের এহেন অসভ্যতার দায় যাঁহার উপর বর্তায়, তিনি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দলীয় অভব্যতা নিয়ন্ত্রণে গত চার বৎসরে তাঁহার রেকর্ড বলিবার মতো নহে। বরং, বিভিন্ন সময় তিনি অভিযুক্তদের আড়াল করিয়াছেন। কখনও ‘ছোট ছেলের ছোট ভুল’ বলিয়াছেন, কখনও কাহারও মগজে অক্সিজেনের অভাবের তত্ত্ব খাড়া করিয়াছেন। আরাবুল ইসলামই একমাত্র ব্যতিক্রম, যাঁহার শাস্তি হইয়াছে, তবে সেই শাস্তি অসভ্যতার কারণে নহে। ইঙ্গিত বুঝিতে সোনালি গুহদের সমস্যা হয় নাই। তাঁহারা জানিয়াছেন, দলনেত্রী তাঁহাদের পার্শ্বে আছেন। বস্তুত, মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং বাক্সংযমে পটু নহেন। বিভিন্ন প্রসঙ্গে তিনি নিজেও এমন সব কথা বলিয়াছেন, যাহা তাঁহার সাংবিধানিক মর্যাদার সহিত সঙ্গতিপূর্ণ নহে। কাজেই, মুখে লাগাম দেওয়ার সংস্কৃতি তাঁহার একেশ্বরীবাদী দলে পায়ের নীচে মাটি পায় নাই। সোনালি গুহ-র সাম্প্রতিকতম কাণ্ডের পর, আশা করা চলে, মুখ্যমন্ত্রী বুঝিবেন, ভুবনের মাসির পরিণতি ভাল হয় না। সোনালি বিধানসভার ডেপুটি স্পিকার, স্বাধিকার সংক্রান্ত কমিটির প্রধানও বটে। এই অতিগুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পদে বসিবার যোগ্যতা তাঁহার কখনও ছিল না। এখন সেটুকুও নাই। বিনা বাক্যব্যয়ে তাঁহাকে বরখাস্ত করাই এখন মুখ্যমন্ত্রীর কর্তব্য। সোনালির ন্যায় চরিত্ররা যাহাতে গণপরিসরে না আসিতে পারেন, সেটুকু নিশ্চিত করিলেও মুখ্যমন্ত্রী গণতন্ত্রের একটি বড় উপকার করিবেন।
তবে, সোনালি গুহরা এই সমাজেরই সন্তান। তিনি যখন জনসভায় মন্তব্যটি করিলেন, তখন কিন্তু সভায় উপস্থিত নেতা-কর্মীরা বিস্ময়ে চুপ হইয়া যান নাই। প্রতিবাদ করেন নাই। বরং, তাঁহারা প্রবল হাততালিতে সোনালিকে উৎসাহ দিয়াছেন। অর্থাৎ, নর্দমার যে পাঁক বেচিতে সোনালি আসরে নামিয়াছিলেন, তাহার উৎসাহী ক্রেতাও বিস্তর আছে। ঘটনাটি সোনালিকে যতখানি চিনাইয়া দেয়, সমাজকেও ততখানি। এইখানেই নাগরিক সমাজের ভূমিকার প্রশ্নটি উঠে। সোশাল মিডিয়ায় সোনালিকে লইয়া ব্যঙ্গবিদ্রুপ চলিতেছে। কিন্তু, বিদ্রুপ এই ঘটনার গুরুত্বকে খাটো করিয়া দেওয়া ভিন্ন আর কিছুই করিবে না। সমাজের ভিতর হইতে স্পষ্ট স্বরে বলিতে হইবে, এই অসভ্যতা রাজনীতির প্রশ্নই নহে, ইহা সামাজিক পরিসরে ইতর ব্যবহারের দৃষ্টান্ত। রাজনৈতিক রং নির্বিশেষে তাহার প্রতিবাদ করিতে হইবে। এই দফায় সোনালিকে রাজনৈতিক ঢালের আড়ালটি দিলে চলিবে না। শাস্তি প্রয়োজন। কঠিন শাস্তি।