ভোটের ফলাফলের উপর প্রচারের কী প্রভাব পড়ে, কতটা প্রভাব পড়ে, তাহা লইয়া তর্ক বিস্তর। কিন্তু সেই তর্ক সরাইয়া রাখিলেও নির্বাচনী প্রচার অপ্রাসঙ্গিক হয় না। বিভিন্ন দল এবং নেতা এই পর্বে নিজেদের কী ভাবে পেশ করিতে চাহেন এবং পারেন, তাহা গণতন্ত্রের পক্ষে তাৎপর্যপূর্ণ। মুখ এবং মুখোশের নিষ্ফল সূক্ষ্মবিচারে কালাতিপাতের বদলে প্রচারকে প্রচার হিসাবে গণ্য করিয়াই তাহার অর্থ সন্ধান করা ভাল। লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীর দল কত শতাংশ ভোট পাইবে, কয়টি আসন লাভ করিবে, সরকার গড়িতে পারিবে কি না, পারিলেও বাহিরের সমর্থন আবশ্যক হইবে কি না, সেই সকল প্রশ্ন আপাতত অলস জল্পনার বিষয়, সুতরাং অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু ইহা অনস্বীকার্য যে, নির্বাচনী প্রচারকে তিনি এক ভিন্ন মাত্রায় তুলিয়াছেন। তাহার ফলে বাতাস ছুটুক না ছুটুক, তুফান উঠুক না উঠুক, অন্যান্য দল ও নেতা হইতে তিনি নিজেকে স্বতন্ত্র করিয়া লইতে পারিয়াছেন। প্রচারের একটি প্রধান লক্ষ্য: বিপণন। সফল বিপণনের প্রথম শর্ত: অনেকের ভিড়ে নিজেকে স্বতন্ত্র প্রতিপন্ন করা। মোদী তাহাতে সফল।
এই সাফল্যের পিছনে বিপণনের বিপুল ব্যবস্থাপনা এবং ব্যয়ের ভূমিকা আছে, কিন্তু তাহা বহিরঙ্গ ভূমিকা। সাফল্যের মূল কারণ, নরেন্দ্র মোদী নিজের ভাবমূর্তিকে রাষ্ট্রনায়কের বৃহৎ মঞ্চে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন। ‘সরকার চালাইবার জন্য অন্যের সাহায্যের দরকার হইবে না, কিন্তু দেশ চালাইবার জন্য (রাহুল গাঁধী-সহ) সকলের সাহায্য আবশ্যক হইবে’ তাঁহার এই উক্তিটি স্পষ্টতই সুপরিকল্পিত। দেশবাসী আশা করিবে তিনি সুযোগ পাইলে এই সদুক্তি পালন করিবেন, আপাতত ইহা উক্তিমাত্র। কিন্তু দল বা উপদলীয় গোষ্ঠীর চোরাবালি এড়াইয়া এই উত্তরণের উদ্যোগটি তাঁহার প্রচার পরিকল্পনার বুদ্ধিমত্তা প্রমাণ করে। দল তথা সঙ্ঘ পরিবারের বিবিধ নেতার মুখে ক্রমাগত ইহার বিপরীত নির্বোধ সংকীর্ণতার কুবাক্য শোনা যাইতেছে। দলনেতার দায়িত্ব তাহা বন্ধ করিতে যথেষ্ট তৎপর হওয়া। অশালীন বিদ্বেষের অসংযত প্রচারকে ‘নির্বাচনী উত্তাপ’ বলিয়া তুচ্ছ করিলে মোদী ভুল করিবেন, নিজের ক্ষতিও করিবেন। নিজের উত্তরণের স্বার্থেই তাঁহার এখনও শিখিবার এবং শিখাইবার আছে।
শিখিবার আছে তাঁহার প্রতিপক্ষ দলগুলিরও। কংগ্রেসের নেতারা এখনও একটি সুসংহত ইতিবাচক অবস্থান তৈয়ারি করিতে পারেন নাই, অবশিষ্ট সময়ে পারিবেন, এমন লক্ষণও নাই। তাঁহারা নানাবিধ খুচরা তর্কেই সময় ও শ্রমশক্তি ব্যয় করিয়া চলিয়াছেন, অথবা ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতিকে অত্যন্ত স্থূল এবং উৎকট রূপে ব্যবহারের চেষ্টা করিতেছেন ‘মুসলিম ওবিসি’ বিষয়ক সাম্প্রতিক উদ্যোগ লক্ষণীয়। হয়তো তাঁহারা নিজেরাও উপলব্ধি করিয়াছেন, বৃহতের সাধনা তাঁহাদের সম্পূর্ণ হাতের বাহিরে চলিয়া গিয়াছে, এখন ক্ষুদ্রই সুন্দর। ক্ষুদ্রের সাধনা পশ্চিমবঙ্গেও অতি প্রকট। কংগ্রেসের উদ্যম এ রাজ্যে দৃষ্টি ও শ্রুতির অগোচর, সি পি আই এমও তথৈবচ, কেবল এখন কমরেডরা ঘোলা জলে মাছ ধরিবার আশায় আশায় রহিয়াছেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল ও তাহার নেত্রীর নির্বাচনী প্রচারেও বৃহতের চিহ্নমাত্র খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না। বিবিধ ক্ষুদ্র এবং স্থানীয় বিষয় লইয়াই তাঁহারা পাড়া মাথায় করিতেছেন। দেশের সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি বিষয়ে কোনও সামগ্রিক ভাবনার প্রকাশ তাঁহাদের কথায় নাই। বস্তুত, নরেন্দ্র মোদীর ভাবমূর্তির স্বাতন্ত্রের পিছনে অন্যদের ক্ষুদ্রতার অবদান কতখানি, তাহাও একটি প্রশ্ন বটে। গালিভারকে লিলিপুটদের দেশে দৈত্যাকার দেখাইয়াছিল।