ভারতীয় রাজনীতিতে, বিশেষত দক্ষিণ ভারতের তামিল রাজনীতিতে শ্রীলঙ্কা পুনরায় আলোচনার শিরোনামে। শ্রীলঙ্কা বলিতে অবশ্যই শ্রীলঙ্কার তামিল জনগোষ্ঠীকে বুঝাইতেছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার পর্ষদে শ্রীলঙ্কা সরকারের তামিল-নীতির বিরুদ্ধে আনীত প্রস্তাবের উপর ভোটাভুটিতে দিল্লি ভোটদানে বিরত থাকায় ভারতীয় বিদেশ নীতির স্বাতন্ত্র্য রক্ষিত হইয়াছে ঠিকই। তবে তামিলনাড়ুর সব রাজনৈতিক দলই এ জন্য ইউপিএ সরকারের তীব্র সমালোচনা করে। কিন্তু ভারত যে শ্রীলঙ্কার মহিন্দা রাজাপক্ষের সরকারকে বেজিংয়ের দিক হইতে টানিয়া রাখিতে গিয়া দ্বীপভূমির তামিলদের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেয় নাই, তাহা প্রতিপন্ন করিতেই সম্ভবত উত্তর-পূর্ব শ্রীলঙ্কার প্রথম নির্বাচিত তামিল মুখ্যমন্ত্রী সি এস বিঘ্নেশ্বরণকে চেন্নাইয়ে আনার চেষ্টা চলিতেছে। তাঁহাকে তামিলনাড়ুতে আনিতে পারিলে কংগ্রেসের পক্ষেও নির্বাচনের আগে কিছুটা অনুকূল সুবাতাস প্রবাহিত করা সম্ভব।
বিঘ্নেশ্বরণ নিজেও তামিলনাড়ু সফরে যথেষ্ট আগ্রহী। তবে তিনি মনে করেন, মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার সহিত সাক্ষাৎ করিতে না পারিলে তাঁহার আগমন প্রাপ্য মর্যাদা পাইবে না। এ দিকে জয়ললিতা বিঘ্নেশ্বরণকে সাদর সংবর্ধিত করিয়া শ্রীলঙ্কা সরকারের তামিল-নীতির পরোক্ষ জয়গান গাহিতে অনিচ্ছুক। নির্বাচনের মরসুমে তামিলদের স্বার্থের একমাত্র রক্ষক হওয়ার প্রতিযোগিতায় তিনি কেবল করুণানিধিকে হারাইয়াই তুষ্ট থাকিতে নারাজ। এ ব্যাপারে বিঘ্নেশ্বরণও তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বী, হউন না তিনি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের তামিলভাষীদের মুখ্যমন্ত্রী। জয়ললিতা যে বরাবর শ্রীলঙ্কার জঙ্গি তামিল রাজনীতির তীব্র বিরোধী ছিলেন, এলটিটিই-র প্রতিও কোনও সহানুভূতি দেখান নাই, ইহা সম্ভবত তাঁহার সমর্থকদের স্মরণ নাই। তাই তিনি এমন অনায়াসে আজ রাজীব গাঁধীর তামিল ঘাতকদের মুক্তি দিতে উদ্যত হন। তামিল আবেগকে পুঁজি করিয়া ভোটের রাজনীতি অনুশীলন করিতে গিয়া ন্যায়বিচারের সাংবিধানিকতাও তিনি প্রত্যাখ্যান করিতে প্রস্তুত। বিঘ্নেশ্বরণ প্রশ্নেও তিনি সেই সংকীর্ণ রাজনীতিই অনুসরণ করিতেছেন।
বিঘ্নেশ্বরণের ভারত সফর শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মহিন্দা রাজাপক্ষকেও নিরুদ্বিগ্ন করিত। ক্রাইমিয়ার ঘটনাবলি এবং রুশ সামরিক হস্তক্ষেপে রুশ অভিবাসী অধ্যুষিত ইউক্রেনের এই অঞ্চলের বিচ্ছিন্ন হইয়া রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরম্পরা হয়তো বা রাজাপক্ষের রাতের ঘুম কাড়িয়া লইয়াছে— ভারত যদি কখনও শ্রীলঙ্কার তামিল-অধ্যুষিত জাফনা ও পূর্ব প্রদেশে ধূমায়িত ইলমের স্বপ্নকে সাকার করিতে সামরিক পদক্ষেপ করে! লক্ষণীয়, তাঁহার বিদেশমন্ত্রীকে তিনি তড়িঘড়ি ক্রাইমিয়ায় রুশ হস্তক্ষেপ লইয়া বিবৃতি দেওয়ার জন্য ভর্ৎসনা করিয়াছেন। নয়াদিল্লির সহিত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিবিড় করিতে তিনিও শ্রীলঙ্কার তামিল মুখ্যমন্ত্রী বিঘ্নেশ্বরণের তামিলনাড়ু সফরের পৃষ্ঠপোষকতা করিতে প্রস্তুত। এই অবস্থায় মুখ্যমন্ত্রী বিঘ্নেশ্বরণের সামনে এক সুবর্ণসুযোগ উপস্থিত— সিংহলি কর্তৃপক্ষের সহিত দর কষাকষি করিয়া উত্তর ও পূর্বের তামিলদের জন্য যথাসম্ভব স্বশাসন ও সুযোগসুবিধা আদায় করিতে সচেষ্ট হওয়া। এ কাজে তাঁহার সাফল্যের উপরেই নির্ভর করিবে, নির্বাচনের পরে নয়াদিল্লির পরিবর্তিত রাজনৈতিক নেতৃত্ব শ্রীলঙ্কা সরকারের প্রতি কী মনোভাব গ্রহণ করিবে। সেখানেই তামিল মুখ্যমন্ত্রীর সফর-প্রস্তাবের তাৎপর্য।