সম্পাদকীয় ১

ভরসা

ষোড়শ লোকসভা নির্বাচন কার্যত সাঙ্গ হইয়াছে। অল্প কিছু বুথে পুনর্নির্বাচনের অনুষ্ঠান বাদ দিলে গণতন্ত্রের এই উৎসবের উপর যবনিকা পড়িয়াছে। অতঃপর ফল প্রকাশের অপেক্ষা । উৎসব ছাড়া বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের এই নির্বাচনকে আর কীই বা বলা যায়? এক মাসেরও অধিক কাল ধরিয়া দফায় দফায় যে ভোটগ্রহণ পর্ব সম্পন্ন হইয়াছে, তাহার আগে যে বর্ণাঢ্য নির্বাচনী প্রচার গোটা প্রাক-নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে রঞ্জিত, উত্তেজনাপূর্ণ— এবং বিদ্বেষ-বিষাক্ত— করিয়াছে, সর্বোপরি যে বিপুল উদ্দীপনা ও উৎসাহের সহিত ভোটদাতারা তীব্র সৌরদাহ উপেক্ষা করিয়া দীর্ঘ সময় বুথের লাইনে প্রতীক্ষায় দাঁড়াইয়া থাকিয়াছেন-- সে সবই এক অনুপম উৎসবের উপাদান।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০১৪ ০০:০৫
Share:

ষোড়শ লোকসভা নির্বাচন কার্যত সাঙ্গ হইয়াছে। অল্প কিছু বুথে পুনর্নির্বাচনের অনুষ্ঠান বাদ দিলে গণতন্ত্রের এই উৎসবের উপর যবনিকা পড়িয়াছে। অতঃপর ফল প্রকাশের অপেক্ষা । উৎসব ছাড়া বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের এই নির্বাচনকে আর কীই বা বলা যায়? এক মাসেরও অধিক কাল ধরিয়া দফায় দফায় যে ভোটগ্রহণ পর্ব সম্পন্ন হইয়াছে, তাহার আগে যে বর্ণাঢ্য নির্বাচনী প্রচার গোটা প্রাক-নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে রঞ্জিত, উত্তেজনাপূর্ণ— এবং বিদ্বেষ-বিষাক্ত— করিয়াছে, সর্বোপরি যে বিপুল উদ্দীপনা ও উৎসাহের সহিত ভোটদাতারা তীব্র সৌরদাহ উপেক্ষা করিয়া দীর্ঘ সময় বুথের লাইনে প্রতীক্ষায় দাঁড়াইয়া থাকিয়াছেন-- সে সবই এক অনুপম উৎসবের উপাদান। অনুপম এবং ধর্মনিরপেক্ষ। এমন ধর্মনিরপেক্ষ উৎসবও আর দুইটি নাই, যদিও ধর্মীয় এবং সাম্প্রদায়িক আবেগ উস্কাইয়া অনেক দল ও প্রার্থীই জনাদেশকে নিজেদের অনুকূলে প্রভাবিত করার অপচেষ্টা করিয়া থাকেন!

Advertisement

এমন একটি বিপুল, মহাভারতীয় কর্মকাণ্ড নিষ্পন্ন করার জন্য নির্বাচন কমিশন দেশবাসীর কৃতজ্ঞতাভাজন হইবেন। কমিশন একটি সাংবিধানিক সংস্থা হইলেও তাহার উপর প্রবল চাপ সৃষ্টিতে রাজনৈতিক দলগুলি সিদ্ধহস্ত। সেই চাপ প্রতিহত করিয়া কিংবা পাশ কাটাইয়া দেশময় একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সুনিশ্চিত করা নিঃসন্দেহে এক অতি দুরূহ কর্ম। বিশেষত প্রাক-নির্বাচনী হিংসা, ভোটগ্রহণের দিন সংঘটিত পরিকল্পিত কিংবা স্বতঃস্ফূর্ত সন্ত্রাসের উপর যথাসম্ভব লাগাম পরাইয়া গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটি নিষ্পন্ন করা বিরাট চ্যালেঞ্জ। বিশেষত যখন কমিশনের নিজস্ব কোনও কর্মী-দল বা নিরাপত্তা বাহিনী নাই, বিভিন্ন রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রের অফিসার-কর্মচারীদের দিয়াই নির্বাচন পরিচালনা করিতে হয় এবং রাজ্যের পুলিশ বাহিনী ও কেন্দ্রের আধা-সামরিক বাহিনী দিয়া শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখিতে হয়। এই সূত্রেই এ বার নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মী ও নিরাপত্তা বাহিনী গড়িয়া তোলার দাবিও উঠিয়াছে। তবে তাহা বাস্তবসম্মত নয়। তা ছাড়া নির্বাচন কমিশন দেখাইয়া দিয়াছে যে, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা থাকিলে রাজনৈতিক দলগুলির চাপ ও ব্ল্যাকমেল-এর রাজনীতি অগ্রাহ্য করিয়া বহু দূর পর্যন্ত অবাধ নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব। কিছু বিচ্যুতি বা বিকৃতি ঘটিয়াছে। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন পর্বে যে ধরনের অশান্তি দেখা গিয়াছে তাহা আদৌ নগণ্য নহে। এবং সেই অশান্তি নিবারণে ও তাহার মোকাবিলায় নির্বাচন কমিশনের যথেষ্ট তৎপরতা দেখা গিয়াছে, এমন কথাও বলিবার উপায় নাই। বস্তুত, এ বারের নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচন কমিশনের কৃতিত্বের তালিকায় পড়িবে না। ইহা পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে অগৌরবের, কমিশনের পক্ষেও।

এই নির্বাচনের সর্বাপেক্ষা বড় প্রাপ্তি অবশ্যই জনসাধারণের বিপুল উৎসাহ। বিশেষত, ভোটাধিকার প্রয়োগ করার যে আকুলতা বা তাগিদ নব্য ভোটারদের মধ্যে লক্ষ করা গিয়াছে, যে বিপুল সংখ্যায় মহিলারা ভোটের লাইনে দাঁড়াইয়া অপেক্ষা করিয়াছেন, তাহা নজিরবিহীন এবং আগের সব রেকর্ডকে ছাপাইয়া গিয়াছে। গণতন্ত্র গভীরগামী হওয়ার পাশাপাশি ব্যাপ্তিতেও যে ক্রমপ্রসরমাণ, ইহা তাহারই প্রমাণ। যাবতীয় বিকৃতি ও স্খলন সত্ত্বেও ভারতে প্রতিনিধিত্বমূলক পরিষদীয় শাসনব্যবস্থা যে জনচেতনায় বদ্ধমূল হইয়া গিয়াছে, ইহা তাহারও প্রমাণ। একই সঙ্গে এই প্রমাণ ভারতীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের রক্ষাকবচও বটে। এ দেশের বহুদলীয় গণতন্ত্র যে অনেক প্রতিবেশী রাষ্ট্রের একদলীয় বা ব্যক্তিগত স্বৈরাচার অথবা ফৌজি একনায়কত্বের দিকে ঝুঁকিবে না, বরং তাহার সমস্ত ত্রুটি লইয়াই উত্তরোত্তর সমাজের গভীরে শিকড় বিস্তার করিয়া চলিবে, ষোড়শ লোকসভা নির্বাচন সেই ভরসাটিও নূতন করিয়া রচনা করিয়া দিল।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement