প্রবন্ধ ২

মোদীর কাছে ব্যবসায়ীদের প্রথম দাবি

প্রথম দাবি জিএসটি। সারা দেশে অভিন্ন পণ্য ও পরিষেবা কর। এটি চালু হলে ক্রেতাদের সাশ্রয় হবে, বিরাট সুবিধে হবে বিক্রেতাদেরও। ব্যবসায়ীদের ‘সিগারেট খরচ’ও বাঁচবে। সুপর্ণ পাঠকজিএসটি এলে নাকি অনেক ব্যবসায়ীর সিগারেট খরচ কমে যাবে— মন্তব্য করলেন কলকাতার এক প্রবীণ ব্যবসায়ী। তিনি বিখ্যাত তাঁর সদাহাস্যময় উপস্থিতি এবং রসাল মন্তব্যের জন্য। তাই তাঁর কথা শুনে প্রথমে ভেবেছিলাম হেঁয়ালি করছেন। কিন্তু ব্যাখ্যাটা শোনার পরে আমার আক্কেল গুড়ুম। বিক্রয় কর সংক্রান্ত ফাইল পাস করাতে গিয়ে দফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মীকে প্রতিটি কাজের জন্য নাকি একটা সিগারেট প্যাকেট খুশি হয়ে দিতে হয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০১৪ ০০:০২
Share:

জিএসটি এলে নাকি অনেক ব্যবসায়ীর সিগারেট খরচ কমে যাবে— মন্তব্য করলেন কলকাতার এক প্রবীণ ব্যবসায়ী। তিনি বিখ্যাত তাঁর সদাহাস্যময় উপস্থিতি এবং রসাল মন্তব্যের জন্য। তাই তাঁর কথা শুনে প্রথমে ভেবেছিলাম হেঁয়ালি করছেন। কিন্তু ব্যাখ্যাটা শোনার পরে আমার আক্কেল গুড়ুম। বিক্রয় কর সংক্রান্ত ফাইল পাস করাতে গিয়ে দফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মীকে প্রতিটি কাজের জন্য নাকি একটা সিগারেট প্যাকেট খুশি হয়ে দিতে হয়। যে কাজ যত ভারী তত দামি সিগারেটের প্রয়োজন। বাবুর ঘর থেকে বেরোলেই পিওন বলে দেন কী সিগারেট লাগবে। দোকানে গিয়ে বাবুর নাম বলে সেই সিগারেট কিনে পিওনকে টাকা দিয়ে দিলেই কাজ শেষ।

Advertisement

এক প্যাকেট সিগারেটেই কাজ শেষ? মনে হয়েছিল, একে তো উপঢৌকন হিসাবে গ্রাহ্য করাই উচিত হবে না আজকের দুনিয়ায়। কিন্তু বিস্তারে শুনে বুঝলাম, লেনদেন প্রক্রিয়াটি একেবারে বিজ্ঞানের স্তরে উন্নীত হয়েছে। সিগারেটের ব্র্যান্ড আসলে একটা সংকেত। কাজের জন্য কতটা উপঢৌকন দিতে হবে তার সূচক। বাবুর নাম করে ব্র্যান্ড বলে দিলে দোকানদারই তার দাম বলে দেবে, যার সঙ্গে অবশ্যই ছাপা দামের কোনও সঙ্গতি নেই। পাঁচ হাজার দশ হাজার যাই হোক না কেন, তা ওই সিগারেটের দোকানদারকে দিলে নির্দিষ্ট সিগারেটের প্যাকেটটি আপনার হাতে আসবে। ওটি নিয়ে বাবুর হাতে দিলে কাজ শুরু হবে। বাবু ওই প্যাকেট দোকানদারকে দিয়ে তাঁর টাকা নিয়ে নেবেন। তার পর ভাগবাটোয়ারা। ঘুষের এই টোকেন সিস্টেম শুনে হাসব না কাঁদব বুঝে উঠতে পারিনি।

মোদী সরকার আসার পরে ব্যবসায়ী মহলে এত উৎসাহ কেন? উত্তর একটাই। এ বার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন এমন এক জন মানুষ যিনি ব্যবসা এবং ব্যবসায়ীর সমস্যা বোঝেন। গদিতে বসছেন বিপুল শক্তি নিয়ে। তাই এবার লাল ফিতের রঙ ফিকে হবে। ব্যস। শিল্পমহলের আসল চাহিদা এটাই। যেমন, কর ব্যবস্থা। দেশের জটিল কর ব্যবস্থা সরল হলে সিগারেট প্যাকেটের লেনদেন কমবে, ব্যবসা চালানোর ঝক্কিও কমবে। এবং এখানেই ‘গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স’ (জিএসটি) চালু করার গুরুত্ব।

Advertisement

এই বিশ্বাস একেবারেই অযৌক্তিক নয়, কেন, তা বোঝার জন্য একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। ধরা যাক এক ব্যবসায়ীর কথা যিনি চামড়ার ব্যাগ তৈরি করেন। কিন্তু এ জন্য তাঁকে অন্যান্য অনেক কিছুর সঙ্গে মেটাতে হবে কেন্দ্রীয় উৎপাদন শুল্ক। এই শুল্ক তো তিনি নিজের পকেট থেকে দেবেন না, সেটা দামের সঙ্গে জুড়ে যাবে। এ বার যখন সেই ব্যাগ দোকান থেকে বিক্রি হবে, তার উপরে দিতে হবে ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স (ভ্যাট) বা যুক্তমূল্য কর। এই করের হিসাবে কিন্তু উৎপাদন শুল্ককেও ধরে নেওয়া হয়। অর্থাৎ এক জন ক্রেতাকে কেন্দ্রীয় সরকারি কর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই করের উপরে রাজ্য সরকারকেও কর দিতে বাধ্য থাকছেন।

করের সংখ্যা যত বেশি, ব্যবসা চালানোর খরচ তত বেশি, ঝঞ্ঝাটও। সেই ঝঞ্ঝাটের মধ্যে সিগারেটের প্যাকেটের ব্যাপারটাও থাকে। অঙ্ক খুব সোজা। প্রতিটি করের জন্য একটি নির্দিষ্ট ফাইল। সেই ফাইল সামলানোর জন্য নির্দিষ্ট কয়েক জন কর্মী ও সিগারেটের প্যাকেট। যার প্রতিটি ধাপই মূল্যস্তরের উপর বোঝা

ক্রমাগত বাড়িয়ে চলে, অর্থাৎ ক্রেতাদের আরও আরও বেশি দাম দিতে হয়। উৎপাদন থেকে বিক্রি পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে কত রকম করের ব্যবস্থা রয়েছে তার দিকে চোখ রাখলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে।

ক) উৎপাদনের উপাদান কেনার স্তরে বিক্রয় কর বা যুক্তমূল্য কর। সেই উপাদান যদি কাঁচামাল না হয় তা হলে তা আসবে উৎপাদন শুল্ক মিটিয়ে, যার উপরেও ভ্যাট বসানো আছে। আবার, আমদানি করা কাঁচামাল হলে তার উপরে

দিতে হবে আমদানি শুল্ক, কাউন্টারভেলিং ডিউটি এবং সেস।

খ) উৎপাদন করার পরে উপরের সব কর ধরেই উৎপাদিত বস্তুর দাম নির্ধারিত হবে। কাঁচমাল আমদানি করা হলে তার উপর দেওয়া শুল্কের উপরও বসবে উৎপাদন শুল্ক।

গ) পরিষেবা কর বসবে পণ্য পরিবহণে।

ঘ) দোকান থেকে যখন এই পণ্য বিক্রি হবে তার দামের মধ্যে সরকারি কোষাগার ভরতে যা দিতে হয়েছে তা-ও ধরা থাকবে, সিগারেটের খরচ সমেত। আর আপনি আমি তার উপরে দেব ভ্যাট। মানে, উপঢৌকনের উপরেও একটা রাজস্ব আপনাকে আমাকে দিতে হচ্ছে!

এক পণ্য এবং পরিষেবা কর ব্যবস্থা দেশ জুড়ে চালু হলে কী সুবিধা হবে? নতুন ব্যবস্থায় রাজ্য এবং কেন্দ্রের কর বসানোর অধিকার থাকবে, কিন্তু তার যোগফল সীমাবদ্ধ থাকবে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের মধ্যে। অর্থাৎ ১৪ শতাংশ যদি করের সীমা হয়, তার একটা অংশ রাজ্যের আর বাকিটা কেন্দ্রের কোষাগারে যাবে। এখন যেমন উৎপাদন শুল্কের উপরও আবার রাজ্যের কর চাপে, তখন তা থাকবে না। করের হার নির্ধারিত হবে উৎপাদনের খরচের ভিত্তিতে, কর দিতে হবে প্রতিটি স্তরে যে পরিমাণ মূল্য যুক্ত হবে তার উপরেই। করের উপর কর বসবে না।

পাশাপাশি, এখন করের অঙ্কের হিসাবে গোটা দেশকে বিভিন্ন বাজার হিসাবে দেখতে হয়। নতুন ব্যবস্থায় তার আর প্রয়োজন থাকবে না। এক জন ব্যবসায়ী গোটা পণ্যের দামের হিসাবে গোটা দেশকে একটাই বাজার হিসাবে দেখতে পারবেন। দামের ফারাক যা, সেটা তৈরি হবে পরিবহণের খরচের কারণেই।

ভোট ভিক্ষার দৌড়ে নরেন্দ্র মোদী ক্রমাগত বিনিয়োগ বাড়ানোর উপর জোর দিয়ে এক বছরের মধ্যেই এক পণ্য ও পরিষেবা কর চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আম ব্যবসায়ী মহলে উৎসাহের মূল সূত্র এই প্রতিশ্রুতিই। এক পণ্য ও পরিষেবা করের বিশ্বজোড়া অভিজ্ঞতাও এই উৎসাহে হাওয়া দিয়েছে। প্রায় ১৪০টি দেশে এই জাতীয় কর ব্যবস্থা চালু আছে। নিউজিল্যান্ডে নাকি এই ব্যবস্থা চালু হওয়ার পরি কর আদায় বেড়েছে ৪৫ শতাংশের বেশি। কানাডার উদাহরণও গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের ‘সেনভ্যাট’-এর মতোই বিন্যাস ছিল কানাডার উৎপাদন-ভিত্তিক বিক্রয় করের। হার ছিল ১৩ শতাংশের মতো। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যেই কানাডা এই কর ব্যবস্থা বদলে চালু করে নতুন কর ব্যবস্থা, যার চরিত্র প্রায় আমাদের প্রস্তাবিত পণ্য ও

পরিষেবা কর ব্যবস্থার মতোই। সমীক্ষা বলছে, শুধু এর ফলেই কানাডার আর্থিক বৃদ্ধির হার বেড়েছে দেড় শতাংশ, উৎপাদনশীলতা বেড়েছে প্রায় এক শতাংশ।

শিল্পমহল নিশ্চয়ই চায় যে, পরিকাঠামোর দ্রুত প্রসার হোক, সংস্কারে গতি আসুক। বণিকসভাগুলি তাদের দাবিপত্রে তা লিখছেও। কিন্তু সেগুলো সময়সাপেক্ষ। কর ব্যবস্থার বদল দ্রুত করে ফেলা সম্ভব। শিল্পমহলের দাবি, সেটাই হোক এই সরকারের প্রথম কাজ। সিগারেটের খরচটা কমুক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন