প্রবন্ধ ২...

মেয়েদের মর্যাদা দিন, শান্তির পথ খুলবে

দুনিয়ায় যেখানেই মেয়েদের সুযোগ ও সক্ষমতা বেড়েছে, সেখানেই সংঘাত নিরসন এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা জোরদার হয়েছে। ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের পূর্বলগ্নে লিখছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ সচিব।

Advertisement

জন কেরি

শেষ আপডেট: ০৬ মার্চ ২০১৪ ০৪:৩০
Share:

আন্তর্জাতিক নারী দিবস নিছক ক্যালেন্ডারের একটি তারিখ নয়। এই দিন একটি বিশ্বাস নতুন করে ঘোষণার দিন। সে বিশ্বাস এই যে, মেয়েদের সুযোগ প্রসারিত হলে পৃথিবীতে শান্তি ও সমৃদ্ধির ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ সচিব হিসেবে এই কথাটা আমার প্রতিনিয়ত মনে হয়। প্রেসিডেন্ট আসাদের বিমানবাহিনী যখন সিরিয়ার আলেপ্পোয় এলোপাতাড়ি বোমাবর্ষণ করে চলেছে ও সেই নৃশংস আক্রমণের মধ্য দিয়ে নিজের পৈশাচিক স্বরূপ উন্মোচিত করছে, ঠিক তখনই সিরিয়ার মেয়েরাও তাঁদের সাহস এবং অধ্যবসায়ের মধ্য দিয়ে নিজেদের চিনিয়ে দিচ্ছেন। গত মাসে আমরা মঁত্র’য় এই আশ্চর্য মেয়েদের কয়েক জনের কথা শুনেছি। ইডলিব সংস্থার এক নারী বললেন, ফ্রি সিরিয়া আর্মি নামক আসাদ-বিরোধী মুক্তি বাহিনীর সহযোগী হিসেবে কী ভাবে তাঁরা গ্রামের মানুষকে সাহায্য করেছেন, তাঁরা যাতে নিজের জায়গায় থেকে নিজের জমি চাষ করতে পারেন, সে জন্য চেষ্টা করেছেন। আর এক জন জানালেন, চেকপোস্টে সরকারি প্রহরীদের খাবার সরবরাহ করে তাঁরা মানবাধিকার কর্মীদের বিধ্বস্ত অঞ্চলে ঢোকার সুযোগ করে দিয়েছেন। রণক্ষেত্রে গোলাগুলির মধ্যে দাঁড়িয়ে এ ভাবে কাজ করার ক্ষমতা যদি অসীম সাহসের পরিচায়ক না হয়, তবে সাহস কাকে বলে আমার জানা নেই।
কেবল সিরিয়া নয়, দুনিয়ার বহু জায়গায় মেয়েরা আমাদের যুদ্ধ নিরসনের ভরসা দেন। অর্থনীতিকে উন্নয়নের রাজপথে নিয়ে আসার জন্য যেমন, সংঘর্ষের অবসান ঘটিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তেমনই মেয়েদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধবিগ্রহের মাসুল সবচেয়ে বেশি গুনতে হয় মেয়েদেরই। অথচ শান্তি আলোচনায় তাঁদের কণ্ঠস্বর প্রায় শোনাই যায় না। এই অবস্থা পালটাতে হবে।
যে সব দেশ বিভিন্ন নীতি নির্ধারণে মেয়েদের অংশগ্রহণের সম্পূর্ণ সুযোগ দেয়, তারাই তুলনায় বেশি সুস্থিতি, সমৃদ্ধি এবং শান্তি অর্জন করে। এবং উল্টোটাও সত্য। আলাপ আলোচনার পরিসরে যেখানে মেয়েদের স্থান দেওয়া হয় না, সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা তুলনায় কঠিন, এবং শান্তি এলেও তা যথেষ্ট পাকাপোক্ত হয় না। সেখানে পারস্পরিক বিশ্বাসের ক্ষয় হয়, মানবাধিকার এবং দায়বদ্ধতাকে অনেক সময়েই যথেষ্ট মর্যাদা দেওয়া হয় না।

Advertisement

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, যারা যুদ্ধ করে, তারা নিজেরাই শান্তি চুক্তির কারিগর এবং চুক্তির শর্তগুলি তারা নিজেদের স্বার্থেই তৈরি করে। তাই এটা স্বাভাবিক যে, অন্তত অর্ধেক শান্তি চুক্তি দশ বছরের মধ্যেই ব্যর্থ হয়। সংঘর্ষের মোকাবিলা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় মেয়েদের শরিক করে নিতে পারলে এই প্রবণতা পালটানো সম্ভব। বিভিন্ন ভয়াবহ সংঘাতের ইতিহাস থেকে আমরা এই শিক্ষাই পাই।
এই কারণেই যে সব দেশে যুদ্ধ চলছে বা যুদ্ধের বিরতি ঘটেছে, সেখানে আমরা মেয়েদের সাহায্য করার চেষ্টা করছি। আফগানিস্তানে আমাদের চেষ্টা, যাতে প্রশাসনের সমস্ত স্তরে মেয়েরা যোগ দিতে পারেন। সে দেশে মেয়েরা এখন যে ভাবে এগিয়ে আসছেন, দশ বছর আগেও তা ভাবা যেত না। তাঁরা কোম্পানি তৈরি করছেন। তাঁরা আইনসভার সদস্য হিসেবে কাজ করছেন। তাঁরা স্কুলে পড়াচ্ছেন, ডাক্তার এবং নার্স হচ্ছেন। তাঁদের এই অগ্রবর্তী ভূমিকার উপর ভিত্তি করেই আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ গড়ে উঠছে।

Advertisement

প্রশিক্ষণ। পুতুল তৈরি শিখছেন আফগান মেয়েরা।
কান্দাহার, ২০১০। ছবি: গেটি ইমেজেস।

ভারতে অনেক প্রতিষ্ঠান মেয়েদের ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সেল্ফ-এমপ্লয়েড উইমেন’স অ্যাসোসিয়েশন (সেবা) তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। মেয়েদের স্বনির্ভরতার প্রসারে এবং নিজের গোষ্ঠীতে ও দেশে তাঁদের নেতৃত্ব অর্জনে এই প্রতিষ্ঠান সহযোগিতা করে। আফগানিস্তানের এগিয়ে-আসা মেয়েদের বিভিন্ন দক্ষতা অর্জনের জন্যও সেবা তাঁদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। মেয়েদের স্বনির্ভরতা ও ক্ষমতায়নের প্রসারে ব্যক্তিগত ভাবে ভারতের অনেক মেয়ের সাহসী কর্মকাণ্ডের বহু নিদর্শনও আমাদের সামনে আছে। নির্ভয়া নামে পরিচিত মেয়েটিকে মার্কিন বিদেশ দফতরের ২০১৩ সালের ‘ইন্টারন্যাশনাল উইমেন অব কারেজ অ্যাওয়ার্ড’ মরণোত্তর ভাবে প্রদান করে আমি গর্ব বোধ করেছিলাম। এ বার এই সম্মান দেওয়া হয়েছে লক্ষ্মীকে, যে মেয়েটি অ্যাসিড আক্রমণের শিকার হয়ে অসীম সাহসের সঙ্গে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন এবং এই অপরাধের বিরুদ্ধে ভারতীয় আইনকে কঠোরতর করার সফল আন্দোলনে অগ্রবর্তী ভূমিকা পালন করেছেন। মায়ানমারেও শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং গোষ্ঠী সংঘাত নিরসনে মেয়েদের ভূমিকার প্রসারে আমরা কাজ করছি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিজের দৃষ্টান্তও এ ক্ষেত্রে মূল্যবান। অনেক বছর আগে আমার বাবা বিদেশ দফতরে কাজ করেছেন। আমি যেমন তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করেছি, আমার বোনও তেমনই বিদেশ দফতরের দীর্ঘ দিনের কর্মী। তিনি এক অর্থে পথপ্রদর্শকও বটেন। কিন্তু তিনি একা নন। এটা আকস্মিক ব্যাপার নয় যে, আমাদের দেশের সর্বোচ্চ স্তরের কূটনীতিকদের বেশ কয়েক জন মহিলা। তাঁদের মধ্যে আছেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা সুজান রাইস, রাষ্ট্রপুঞ্জে মার্কিন প্রতিনিধি সামান্থা পাওয়ার, বিদেশ দফতরের উপসচিব হিদার হিগিনবটম, রাজনৈতিক বিষয়ে আন্ডারসেক্রেটারি ওয়েন্ডি শেরম্যান। বিদেশ দফতরের বিভিন্ন অঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত সহকারী সচিবদের মধ্যে এক জন বাদ দিয়ে সবাই এখন মহিলা। কেবল তাঁরা নারী বলেই তাঁদের কাজের মর্যাদা দিচ্ছি না, তাঁরা গোটা দুনিয়ার সমস্ত মানুষের জীবনে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
শান্তি মানে নিছক যুদ্ধবিরতি নয়। সমাজে সবাই যখন স্থিরতা ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে একসঙ্গে কাজ করেন, তখনই যথার্থ শান্তি আসে। এখানেই মেয়েদের বিশেষ ভূমিকা। এই ভূমিকা পালনে মেয়েরা যতটা পথ হেঁটেছেন, আন্তর্জাতিক নারী দিবসের পূর্বলগ্নে আমরা তাকে সম্মান জানাই। আরও বড় কথা, ভবিষ্যতে সেই পথে তাঁরা যাতে এগিয়ে যেতে পারেন, সে জন্য সব রকম সাহায্যের অঙ্গীকার করি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন