আন্তর্জাতিক কূটনীতির প্রথা অনুযায়ী দূতাবাসের ভৌগোলিক অবস্থান নির্বিশেষে তাহা নিজস্ব রাষ্ট্রের আইনের অধীন। অর্থাৎ, নিউজিল্যান্ডের ওয়েলিংটনেই হউক বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে, ভারতীয় দূতাবাসে ভারতের আইন খাটে, সেই দেশগুলির নহে। ভারতীয় কূটনীতিকরা সম্ভবত এই কথাটিকে প্রয়োজনের বেশি গুরুত্ব দিয়া বসিয়াছেন। দেবযানী খোবরাগাড়ে অথবা রবি থাপরের আচরণ বড় বেশি ‘ভারতীয়’ থাকিয়া গিয়াছে। ভুল অর্থে ভারতীয়। দূতাবাসের উচ্চপদস্থ কর্মী হিসাবে তাঁহারা দেশ হইতে একাধিক পরিচারক লইয়া যাওয়ার অধিকারী। বিদেশের মাটিতে সেই কর্মীদের সহিত তাঁহারা যেমন আচরণ করিয়াছেন বলিয়া অভিযোগ, ভারতে হয়তো সেই আচরণে বিশেষ সাড়া পড়িত না। কিন্তু, নিউজিল্যান্ড বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারত নহে। অতএব, বিদেশ মন্ত্রকে অভিযোগ আসিতেছে। দেবযানীর ক্ষেত্রে ভারত মুখ পুড়াইয়াছিল। রবি থাপরের ক্ষেত্রে সতর্ক হইয়াছে। এই ধরনের ঘটনাকে ‘ব্যতিক্রমী’ বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া কঠিন। ২০১২ সালে বিভিন্ন দূতাবাসের কর্মীর বিরুদ্ধে বিদেশ মন্ত্রকে ছয়টি অভিযোগ জমা পড়িয়াছিল। ২০১৩ সালে সংখ্যাটি বাড়িয়া দাঁড়ায় ১০, ২০১৪ সালে ২৭। তাহার মধ্যে গৃহ-পরিচারকের সহিত অমানবিক আচরণের অভিযোগের সংখ্যা কম নহে।
অভিযোগগুলি কয় আনা সত্য, তাহা তদন্তসাপেক্ষ। তাহা ভিন্ন, কেহ বলিতে পারেন, সকল দেশে মানুষের সহিত মানুষের আচরণের গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠি সমান হয় না। তাহা আইনের প্রশ্ন নহে, মূলত সংস্কৃতির প্রশ্ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে ঘটনা মানবাধিকার হরণের শামিল হইবে, ভারতীয় মাপকাঠিতে তাহা হয়তো নিতান্তই স্বাভাবিক। ফলে, এক ভারতীয়র সহিত অপর ভারতীয়র আচরণকে বিদেশি আইনের মাপকাঠিতে মাপা ঠিক হইবে কি? আপত্তিটি একেবারে উড়াইয়া দেওয়ার নহে। প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্কও সংস্কৃতি-নিরপেক্ষ নহে। কিন্তু, কয়েকটি কথা মাথায় রাখা প্রয়োজন। এক, প্রভু-পরিচারকের সম্পর্কের উচ্চাবচতা ভুলিয়া যাওয়া শুধু ভুল নহে, অন্যায়ও। ক্ষমতার দাড়িপাল্লা এক দিকে এত বেশি ঝুঁকিয়া থাকে যে অপর দিকের কথায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া বিধেয়। দুই, বিদেশ মন্ত্রকের নিকট অভিযোগ এমনই জমা পড়ে না। পরিচারকের সহ্যের সীমা ছাড়াইলে তবেই ঘটনাটি দূতাবাসের গণ্ডি টপকায়। তিন, সংস্কৃতি এমন কিছু অলঙ্ঘ্য বাধা নহে যে তাহাকে অতিক্রম করিয়া উন্নততর মানবিক সম্পর্কের পথে হাঁটা সম্ভব হইবে না।
এই প্রসঙ্গে ‘ভারতীয় সংস্কৃতি’র চরিত্রটিও বিচার করিয়া দেখা বিধেয়। ভারতে গৃহ পরিচারকদের সহিত বহু ক্ষেত্রেই যে ব্যবহার করা হইয়া থাকে, তাহা যে কোনও মাপকাঠিতে অগ্রহণযোগ্য। দুঃখজনক ভাবে, নিতান্ত বাড়াবাড়ি না হইলে আইনের সুদীর্ঘ বাহু গৃহের অভ্যন্তরে পৌঁছায় না। ফলে, সেই অস্বাভাবিকতাগুলি ক্রমে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে। যাঁহারা সেই অন্যায়ের শিকার, তাঁহারা নিয়তিকে দোষারোপ করিয়া এই দুর্ভাগ্য মানিয়া লন। প্রভু সামাজিক ভাবে যত ক্ষমতাবান, তিনি ততই আইনের ঊর্ধ্বে। অতএব, তাঁহার দাপটও তত। সিভিল সার্ভিসের রাজপুরুষরা সমাজের উচ্চতম বর্গের অংশ। প্রভুত্ব তাঁহাদের মজ্জাগত। বিদেশের মাটিতেও সেই মজ্জাগত অভ্যাসই সম্ভবত তাঁহাদের চালনা করিতেছে। কাজেই, অভিযোগগুলিকে উড়াইয়া না দিয়া মূলগত সংশোধনের চেষ্টাই বিধেয়।