সম্পাদকীয় ১

মন নাই

সর্বাধিক সংস্কার হইয়াই গিয়াছে, জানাইলেন নরেন্দ্র মোদী। তাঁহার সরকারের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি উপলক্ষে একই সঙ্গে জানাইলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের গুরুত্ব হ্রাস করিবার প্রশ্নই নাই, কারণ ‘উন্নয়নশীল দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে’। অর্থাৎ, নরেন্দ্র মোদী বলিয়া দিলেন, সংস্কার কাহাকে বলে, দুই বৎসরেও তিনি তাহা শিখিয়া উঠিতে পারেন নাই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০১৬ ০০:০০
Share:

সর্বাধিক সংস্কার হইয়াই গিয়াছে, জানাইলেন নরেন্দ্র মোদী। তাঁহার সরকারের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি উপলক্ষে একই সঙ্গে জানাইলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের গুরুত্ব হ্রাস করিবার প্রশ্নই নাই, কারণ ‘উন্নয়নশীল দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে’। অর্থাৎ, নরেন্দ্র মোদী বলিয়া দিলেন, সংস্কার কাহাকে বলে, দুই বৎসরেও তিনি তাহা শিখিয়া উঠিতে পারেন নাই। তিনি প্রতিরক্ষা খাতে, বিমাক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা বৃদ্ধির উদাহরণ টানিয়া নিজের সংস্কারমনস্কতা প্রমাণ করিতে চাহিয়াছেন। তিনি বোঝেন নাই, আর্থিক সংস্কার প্রকৃত প্রস্তাবে কোনও একটি বা দুইটি সিদ্ধান্ত নহে— তাহা ভিন্ন সাধনার ফল। সংস্কার একটি দৃষ্টিভঙ্গি, যাহা প্রচলিত সকল নীতিকেই প্রশ্ন করিতে শেখায়। অর্থনীতির দ্রুততম বিকাশের জন্য কোন নীতি প্রযোজ্য, এবং কোনটি পরিত্যাজ্য, তাহা বিচার করিবার নামই সংস্কার। রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ঝাঁপ গুটাইয়া আনা বিষয়ে কোনও আলোচনাই চলিবে না, এই মানসিকতা সংস্কারের পরিপন্থী। উন্নয়নশীল দেশে কেন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার গুরুত্ব বজায় রাখিতেই হইবে, কেন সরকারের নজরদারিতে বাজার ব্যবস্থাতেই সর্বজনীন উন্নয়ন নিশ্চিত করা যাইবে না, এই প্রশ্নগুলির কোনও উত্তর প্রধানমন্ত্রী দেন নাই। এমনকী, হোটেল বা বিমানবন্দর চালাইবার দায়িত্ব কেন সরকার নিজের হাতে রাখিবে, ‘দরিদ্রদরদি’ মোদীর ঝোলাতেও তাহার কোনও সদুত্তর নাই। এই মানসিকতা সংস্কারের নহে। এই মন রাষ্ট্রবাদী। এই মন জওহরলাল নেহরু-ইন্দিরা গাঁধীর যুগের। মোদীর কথা শুনিয়া জগদীশ ভগবতী হতাশ হইবেন।

Advertisement

আর্থিক সংস্কারের প্রথম কথা, সরকারের পরিসর গুটাইয়া আনা। দুই বৎসর আগে যে প্রতিশ্রুতি নরেন্দ্র মোদী দিয়াছিলেন— ‘ন্যূনতম সরকার, সর্বোচ্চ প্রশাসন’। তাঁহার মন্ত্রিসভার আয়তন বলিবে, প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নের কথা তিনি ভাবিতে সময় পান নাই। এখনও ভারতে কয়লা মন্ত্রক আছে, ইস্পাত মন্ত্রক আছে, রাসায়নিক মন্ত্রক আছে, পরিবহণের চারটি মন্ত্রক আছে, এমনকী গঙ্গা উন্নয়নেরও মন্ত্রক আছে! তাহার উপর আছে অবান্তর নজরদারি সংস্থা তৈরি করিবার অভ্যাস। প্রধানমন্ত্রী এই কথাগুলি উল্লেখ করেন নাই। সম্ভবত, এই চলনের সহিত সংস্কারের বিরোধ আছে, তিনি বোধ করেন না। তাঁহার নিকট সংস্কার বলিতে জিএসটি বিল— দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর কেন্দ্রীয় আধিপত্য চাপাইয়া দেওয়ার অপচেষ্টা— গুরুত্ব পায়। অথচ, সদ্যরচিত দেউলিয়া সংক্রান্ত বিধির কথা তিনি উল্লেখ করিতে ভুলিয়া যান। আর্থিক সংস্কার কেন জরুরি, এবং তাহার জন্য কোন পথে হাঁটা বিধেয়, সে বিষয়ে ভারতীয় রাজনীতিক মহলে অজ্ঞতা ও উদাসীনতা দুস্তর।

শ্রম আইন সংস্কারের প্রশ্নে তিনি বলিয়াছেন, ‘শুধু শিল্পের স্বার্থরক্ষাই নহে’, শ্রমিকের স্বার্থরক্ষাকেও গুরুত্ব দিতে হইবে। অর্থাৎ, তাঁহার মনের গভীরে এখনও একটি ষাটের দশকের বামপন্থী মন বাস করে, যাহার নিকট শিল্প ও শ্রমিকের সম্পর্কটি নির্বিকল্প দ্বন্দ্বের। যথার্থ শিল্পবান্ধব শ্রম আইন রচিত হইলে তাহা যে শ্রমিকের পক্ষেও অনুকূল, এই কথাটি সেই মন মানিতে পারে না। সংস্কার মানে যে সংঘাত নহে, সাযুজ্য— ভারতীয় রাজনীতি তাহা বুঝিতে পারে নাই। ফলে, জমি অধিগ্রহণ বিল আটকাইয়া গিয়াছে। প্রধানমন্ত্রী বলিয়াই দিয়াছেন, বিলটি এখন অতীত। অর্থাৎ, অর্ডিন্যান্সও ব্যর্থ হওয়ায় তিনি চেষ্টা ছাড়িয়া দিয়াছেন। সংস্কারের জন্য যে বিরোধীদের সহিত আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যে পৌঁছাইবার প্রক্রিয়াটি অপরিহার্য, প্রধানমন্ত্রী তাহা বোঝেন নাই। এই মনের চোখ সংস্কারের প্রকৃত রূপ দেখিতে পাইবে না, তাহাতে আশ্চর্য কী?

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন