অহিংস অসহযোগের অস্ত্রটির এমন কুশলী প্রয়োগ দেখিলে মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী সন্তুষ্ট হইতেন। বিশেষত, যাদবপুরের আন্দোলনকারীদের সম্মুখে কোনও পথপ্রদর্শক ছিলেন না। আন্দোলনের প্রতিটি ধাপের প্রতিটি আচরণ তাঁহাদের নিজস্ব। শহরের রাজপথে মিছিল হইয়াছে, ক্যাম্পাস অচল থাকিয়াছে, ছাত্রছাত্রীরা সমাবর্তন উত্সব বয়কট করিয়াছেন, অনশনে বসিয়াছেন। কিন্তু, চার মাসে এমন কোনও ঘটনা ঘটে নাই, যাহার অভিঘাতে গাঁধী বলিতে পারিতেন, সত্যাগ্রহ প্রত্যাহার করিয়া নেওয়া বিধেয়, কারণ আন্দোলনকারীরা তাহার যোগ্য হইয়া উঠিতে পারে নাই। আন্দোলনকারীরা নিজেদের যোগ্যতা, পরিণতমনস্কতা প্রমাণ করিয়াছেন। তাঁহাদের পথভ্রষ্ট হইবার আশঙ্কা যথেষ্ট ছিল। ক্ষমতার চোখে চোখ রাখিয়া সত্য উচ্চারণ করিবার যে লড়াই তাঁহারা লড়িলেন, তাহা সুদীর্ঘ চার মাস চলিল। ধৈর্যচ্যুতি হইতেই পারিত। শাসক দলের উস্কানিও ছিল বিলক্ষণ। যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীরা সেই ফাঁদগুলি সচেতন ভাবে এড়াইয়া গিয়াছেন। প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব রাজনৈতিক শিক্ষা এবং সার্বিক শিক্ষার পরিবেশের মাহাত্ম্য অনস্বীকার্য। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হইতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, ক্ষমতার শীর্ষে অধিষ্ঠিতরা যখন ভাবিয়াও দেখেন নাই যে তাঁহাদের ক্ষুদ্র স্বার্থচর্চায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানহানি হইতেছে, তখন তরুণ ছাত্রছাত্রীরা প্রাণপণ প্রতিষ্ঠানটির সম্ভ্রম রক্ষা করিয়া গিয়াছেন।
কিন্তু, তাঁহারাও স্মরণে রাখিতে পারেন, যাহার উদ্যাপনে ক্যাম্পাসে অকাল বসন্তোত্সব আসিল, তাহা সাফল্যমাত্র। জয় নহে। অতি জরুরি সাফল্য, কিন্তু অভিজিত্ চক্রবর্তী নামক সম্পূর্ণ অযোগ্য এক জন উপাচার্যের পদত্যাগেই তাঁহাদের লড়াই শেষ হইয়া যায় না। বরং, ইহা প্রকৃত লড়াইয়ের প্রথম সোপান। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় নামক প্রতিষ্ঠান হইতে লেখাপড়ার পরিবেশ হারাইয়া গিয়াছে। বহু গবেষণাকেন্দ্রেই কোনও অধিকর্তা নাই। ফলে, গবেষণার কাজ বহুলাংশে অবহেলিত পড়িয়া আছে। অন্য দিকে, আইন পরিবর্তন করিয়া সমস্ত ক্ষমতা উপাচার্যের কুক্ষিগত করা হইয়াছে। ফলে, কোনও রকম গণতান্ত্রিক পরিসর বিশ্ববিদ্যালয়ের অলিন্দে আর নাই। উপাচার্য পদে যিনিই আসুন, তাঁহার একনায়ক হইয়া উঠিবার আশঙ্কা উড়াইয়া দেওয়া যায় না। প্রতিষ্ঠানটিকে প্রকৃতার্থে বিশ্বমানের করিয়া তুলিতে হইলে এই প্রশ্নগুলির যথার্থ সমাধান খুঁজিতে হইবে। কেহ বলিতে পারেন, এই কাজগুলি প্রশাসনের, শিক্ষকদের। ছাত্রদের নহে। কিন্তু যাদবপুরের ছাত্ররা তাঁহাদের আন্দোলনের মাধ্যমেই প্রমাণ করিয়াছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে কঠিনতর দায়িত্ব গ্রহণে তাঁহারা সক্ষম। তাঁহারা প্রকৃত অর্থেই প্রতিষ্ঠানটির অংশীদার। আন্দোলনে তাঁহারা যে দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়াছেন, পরবর্তী ক্ষেত্রেও সেই মান বজায় রাখিতে হইবে। তাহার জন্য যে পুনরায় আন্দোলনই প্রয়োজন, তাহা মনে করিবার কোনও কারণ নাই।
সাবেকি অর্থে যাহাকে শিক্ষার পরিবেশ বলা হইয়া থাকে, যাদবপুরে তাহা ফিরাইয়া আনা ছাত্রছাত্রীদের কর্তব্য। প্রবীণ শিক্ষাবিদরা কেহ কেহ আশঙ্কা প্রকাশ করিয়াছেন, ছাত্ররা বুঝি অতঃপর আন্দোলনের আঁচ পোহাইতেই ব্যাকুল হইবেন। সেই আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণ করিবার দায়িত্ব ছাত্রদেরই। তবে, বৃহত্তর দায়িত্বও আছে। পশ্চিমবঙ্গ নামক সম্পূর্ণ অ-শাসনযোগ্য রাজ্যটিকে পুনরুদ্ধার করা। কাজটি যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীদের একার নহে। রাজ্যের সব ছাত্রছাত্রীর। কিন্তু, নিজেদের যোগ্যতাবলেই যাদবপুরের ছাত্ররা সেই প্রকল্পের প্রথম সারিতে থাকিবেন। শাসনহীনতা যে কোনও রাজ্যের পথ হইতে পারে না, এই কথাটি পশ্চিমবঙ্গে তাঁহাদেরই প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে। কথায় নহে, কাজে। তাঁহারা প্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা ফেরান। যুক্তিসঙ্গত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করুন। সার্বিক নৈরাজ্যের চক্রটি এই বার ভাঙুক।