মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বরং স্পষ্ট বলিতে পারিতেন, এখন কালীঘাট ছাড়িয়া দিল্লি যাওয়া সম্ভব হইবে না। কখন কে কোথায় কী বলিয়া ফেলেন, এবং তাহার ধাক্কায় আবার কোন পাহাড়চূড়ার আতঙ্ক জনসমক্ষে চলিয়া আসে, তাহার ঠিক নাই। এই অবস্থায় দুর্গ ছাড়িয়া বাহিরে যাওয়া শুধু মুশকিলই নহে, অসম্ভব। অথবা এইটুকু বলিলেও চলিত যে আপাতত (দলের নেতাদের) দুর্নীতি লইয়াই শ্বাস ফেলিবার ফুরসত নাই— এখন নীতি আয়োগ লইয়া মাথা ঘামাইবার প্রশ্নই উঠে না। সত্য কথার মার নাই। কিন্তু, বঙ্গেশ্বরী তাঁহার জাতীয় মুখপাত্রকে দিয়া বলাইলেন, বিজেপি-সরকার সত্যই রাজ্যগুলির মতামত লইয়া উন্নয়নের গতিপথ স্থির করিতে চাহিতেছে, তাঁহারা বিশ্বাস করেন না। আশ্চর্য! বিশ্বাস না থাকিলেই তো আরও যাওয়া প্রয়োজন। যদি তাঁহারা জানিতেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বৈঠকে যোগ দিন অথবা সেই সময় টেলি সম্মান বিলি করুন, কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তে পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ রক্ষিত হইবেই— তাহা হইলে ১০৫ জন টেলিশিল্পীর সহিত সময় কাটাইলেও চলিত। কিন্তু যেখানে উন্নয়নের প্রতিটি কণার জন্য যুদ্ধ করিতে হইবে বলিয়া তাঁহারা বিশ্বাস করেন, সেখানে বঙ্গেশ্বরী ঘরে খিল আঁটিয়া বসিয়া রহিলেন? তিনি সম্ভবত জানেন না যে প্রাপ্তবয়স্কদের দুনিয়ায় ‘আব্বুলিস’ দেওয়ার চল নাই।
ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রাজ্যগুলির প্রাপ্য গুরুত্ব আদায়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উৎসাহ, শেষ সংবাদ পাওয়া পর্যন্ত, কম ছিল না। অনুমান করা চলিতে পারে, হাজার ঝামেলায় মুখ্যমন্ত্রী আর সেই দিকে মন দেওয়ার অবকাশ পাইতেছেন না। তিনি টের পান নাই, নরেন্দ্র মোদী যুক্তরাষ্ট্রীয়তার একটি নূতন যুগের সূচনা করিতেছেন। নেহরু যুগে রাজ্যগুলির অধিকার খর্ব করিবার প্রক্রিয়ায় সর্বাপেক্ষা বড় অস্ত্র ছিল যোজনা কমিশন। টাকা আদায় করিতে হইলে রাজ্যগুলির অর্থমন্ত্রীরা কমিশনের দরজায় হত্যা দিয়া পড়িয়া থাকিতেন। কমিশন, অর্থাৎ তাহার বকলমে কেন্দ্রীয় সরকারের মর্জিমাফিক টাকা মিলিত। নরেন্দ্র মোদী এই ব্যবস্থাটিকে কুলার বাতাস দিয়া বিদায় করিয়াছেন। নূতন ‘নীতি আয়োগ’ উন্নয়ন পরিকল্পনায় রাজ্যগুলির মতামতকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিবে। অন্য দিকে, আসন্ন বাজেটে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের তালিকা বহুলাংশে ছাঁটিয়া রাজ্যগুলির হাতে উন্নয়নখাতে অনেক বেশি অর্থ দেওয়ার পরিকল্পনাও আছে। সব মিলাইয়া, উন্নয়নের লাগাম রাজ্যের হাতে আসিতে চলিয়াছে। নীতি আয়োগ তাহার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দরজায় খিল আঁটিয়া বঙ্গেশ্বরী এই নূতন ব্যবস্থার গঠনপ্রক্রিয়া হইতে পশ্চিমবঙ্গকে সরাইয়া রাখিলেন।
তর্কের খাতিরে ধরিয়া লওয়া যাক, মুখ্যমন্ত্রী যাহা আশঙ্কা করিতেছেন, তাহাই ঠিক— সত্যই কিছু করিবার সদিচ্ছা কেন্দ্রীয় সরকারের নাই, নীতি আয়োগ বস্তুটি কোনও কাজের জিনিস হইবে না। কিন্তু আলোচনার পরিসরটি যখন খোলা, তখন তাহার যথার্থ ব্যবহারে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘মুখোশ’ খুলিয়া দেওয়াও তো গণতান্ত্রিক কর্তব্য, তাহার জন্যও আলোচনায় যোগ দেওয়া বিধেয়। এই পরিসরেই উন্নয়নের রূপরেখা লইয়া দরকষাকষি হইবে। রাজ্যের স্বার্থ আদায়ের জন্য রাজ্যের প্রতিনিধিকেই লড়িতে হইবে। এত দিন এই পরিসরটিই ছিল না। বঙ্গেশ্বরী যুক্তরাষ্ট্রীয়তার স্বার্থে, পশ্চিমবঙ্গের কথা ভাবিয়া তাহাকে ব্যবহার করিতে পারিতেন। কিন্তু, তাঁহার পাখির চোখ রাজনীতি। বিজেপি তাঁহার বিরুদ্ধে সিবিআই-কে ব্যবহার করিতেছে বলিয়া তাঁহার দল পোস্টার সাঁটিতেছে। এই অবস্থায় ‘তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়’ ‘বিজেপি-র নেতা নরেন্দ্র মোদী’-র সহিত বৈঠক করিতে অনিচ্ছুক হইবেন, স্বাভাবিক। মানিক সরকার দলের ঊর্ধ্বে দেখিতে পান, কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে তাহা অসম্ভব। অতএব, রাজনীতিই থাকিল।