প্রবন্ধ ২

লাল চোখ, সাদা মন

আরে বাবা, পৃথিবীতে সব কিছুর একটা তরিকা আছে। রাস্তা পেরোবার সময় ডাঁয়েবাঁয়ে দেখে, সাবধানে চলতে হয়। মস্তানরা যখন কোনও মেয়েকে মোলেস্ট করছে, বাজারের মাঝখানে ব্লাউজ ছিঁড়ে দিচ্ছে, টানতে টানতে পাঁচিলের ও-পারে নিয়ে যাচ্ছে, নিশ্চয়ই কারণ আছে বলেই করছে। হয়তো মেয়েটা কোনও মিষ্টিমানুষকে লেঙ্গি মেরেছিল, বা টোন-কাটার বিরুদ্ধে বড় বড় বাতেলা মেরেছিল,বা সিম্পলি টাইট জামাকাপড় পরে বেরিয়ে আমাদের চাগিয়ে তুলেছিল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:৫৩
Share:

আরে বাবা, পৃথিবীতে সব কিছুর একটা তরিকা আছে। রাস্তা পেরোবার সময় ডাঁয়েবাঁয়ে দেখে, সাবধানে চলতে হয়। মস্তানরা যখন কোনও মেয়েকে মোলেস্ট করছে, বাজারের মাঝখানে ব্লাউজ ছিঁড়ে দিচ্ছে, টানতে টানতে পাঁচিলের ও-পারে নিয়ে যাচ্ছে, নিশ্চয়ই কারণ আছে বলেই করছে। হয়তো মেয়েটা কোনও মিষ্টিমানুষকে লেঙ্গি মেরেছিল, বা টোন-কাটার বিরুদ্ধে বড় বড় বাতেলা মেরেছিল,বা সিম্পলি টাইট জামাকাপড় পরে বেরিয়ে আমাদের চাগিয়ে তুলেছিল। তালি তো আর এক হাতে বাজে না। তুমি মাঝখান থেকে হামলে পড়ে সভ্যতা শেখাতে গেছ কেন হে? অন্যের ব্যাপারে খামকা নাক গলানো যে অভদ্রতার সাইনবোর্ড, মাথায় ঢোকে না?

Advertisement

পৃথিবীর টিপটপ ডেকোরাম বলে, নিজের কাজ করো, অন্যকে নিজের কাজ করতে দাও। আমরা তো কথা নেই বাত্তা নেই যাকে-তাকে ধরে পেটাতে শুরু করি না। যারা ডিসেন্ট মানুষ, সাতে পাঁচে পঁয়ত্রিশে নেই, চুপচাপ মাথা নিচু করে দোকান-বাজার যায়, টিভি দেখে, তাদের কক্ষনও কিচ্ছু বলেছি? হয়তো ক্লাবে গিয়ে একটা লোককে তুলে আনতে হবে, আমরা সিধেসাপ্টা হুমকি দিই, একে নিয়ে যাব, বাকিরা সরে দাঁড়াও। যদি সবাই সুড়সুড় করে কেটে যায়, আমরা নিপুণ ক্রেনের মতো টার্গেটটাকে তুলে নিই, কারও চুলের ডগাও ছুঁই না। এ বার, কেউ যদি হঠাৎ পেছনপাকামো করে এইও বলে লাফিয়ে ওঠে, বা বাসে উঠে যখন একটা লোককে টিপ করে গুলি করছি তখন খামকা কানের কাছে চিল্লামিল্লি জোড়ে, কনসেনট্রেশন নড়ে যায় না? প্রখর কাজের সময় কেউ যদি ডিসটার্ব দেয়, আপনি মাথা ঠান্ডা রাখতে পারেন?

এখন আমাদের নামে তোড় চলছে। কিছু এসে যায় না। কাককে সবাই ঘেন্না করে, কিন্তু সে-ই পাড়া সাফ রাখে। আমরা জরুরি যে জিনিসটা সমাজে জিইয়ে রাখি: ভয়। অনেকে ভাবে, ভয় পাওয়া খারাপ, কিন্তু ভয় না থাকলে মানুষ ব্যালান্সটাই তো রাখতে পারত না! বাচ্চারা ভয় পায় না, আগুনে হাত দিতে যায়। টিন-এজাররা ভয় পায় না, ফাঁকা দুপুরে সহপাঠীর সঙ্গে সেক্স করে ফেলে। বাপ-মা তখন তাদের বেধড়ক শাসন করে সুস্থ সুন্দর জিন্দেগির দিকে নিয়ে আসে না? সার্জেন্টের ভয় থাকে বলেই গাড়িরা সিগনালে থামে, অন্ধকারে ভয় লাগত বলেই টমাস আলভা এডিসন বাল্ব আবিষ্কার করলেন। আমরা সেই ভয়ের এজেন্ট। লোককে সংযত হতে শেখাই, নিজেকে প্রশ্ন করতে শেখাই, ‘আরে ছাড়, কী দরকার?’ সাংঘাতিক ইম্পর্ট্যান্ট প্রশ্ন। সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছ যাও না, পাশের গলিতে মার্ডার হচ্ছে, রকের ধারে রেপ হচ্ছে, তোমার কী দরকার? হ্যাঁ, এ সব দেখলে নাদান মানুষের রিফ্লেক্স অ্যাকশনে মুঠো শক্ত হয়ে ওঠে, ফট করে ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার ইনস্টিংক্ট কাজ করে। কিন্তু প্রবৃত্তি ভাল জিনিস না, তাকে দমাও, নিজেকে জিজ্ঞেস করো, ‘কী দরকার?’ বাধা দিতে গেলে রেপটাও হবে, আমিও মরব। একটা ক্রাইম হত, দুটো হবে। তার চেয়ে, চুপচাপ পাশ দিয়ে চলে গেলে, অফিসে গল্পটা রসিয়ে করতে পারব। প্র্যাকটিকাল হও, সুখ শেখো।

Advertisement

এখন অবশ্য মানতেই হবে, ইয়াং প্রজন্মকে এই লেস্নটা বাড়ি থেকে পইপই করে চমৎকার শিখিয়ে দেওয়া হচ্ছে। রিস্কি মিছিলে যাবি না, কেউ অপমান করলে তার সঙ্গে মুখ লাগাতে যাবি না, সেক্স-ইশারা দেখলে তাড়াতাড়ি মুখ নিচু করে বুকে ফাইল চেপে জায়গাটা পেরিয়ে যাবি, রাত এগারোটার পর যখন সাইলেন্সার খুলে বাইকগুলো সাতাশি বার পাড়া রাউন্ড মারবে, ঘরে শুয়ে বিড়বিড়িয়ে গাল দিবি কিন্তু বারান্দায় বেরোবি না। এই সুশিক্ষাগুলো বজায় থাকত না, একটা ধারাবাহিক অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে সমাজে পুঁতে যেত না, যদি না আমরা রেগুলার টহল মারতাম। আসল লোক, অবশ্যই, আমাদের মনিবরা। সমাজের ভাল-র জন্যে যাঁদের ঘুম হয় না। লাল-লাল চোখ নিয়ে যাঁরা শান্তি বজায় রাখার জন্য চরকি কাটছেন। তাঁরা আমাদের বলেন, দুষ্টু লোকেরা ভোটে বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে, তাদের ধোলাই দিতে হবে, বুথ জ্যাম করতে হবে, দরকারে হাত কেটে ফেলতে হবে, বাড়ি জ্বালাতে হবে, মেয়েছেলে দেখলে খুচখাচ ভোগ করে নিতে হবে। এইগুলো এমনিতে ভাল না, কিন্তু মহান লোকেদের আদর্শগুলো বাস্তবে প্রয়োগ করতে গেলে, একটা জমি চাই। সেটা তৈরি হতে সময় লাগে, আর তার মধ্যে বহু উটকো লোক কাঠি করতে শুরু করে। এ আগাছাদের ফোর্স দিয়ে উপড়ে না নিলে, বিপ্লব হবে না। অংক বোঝাতে গেলে চড় মারতে হয়। মশাকে প্রাণে না মারলে হিউম্যান কলোনি পত্তন হয় না।

অবশ্য সে সবের আগে প্রশ্ন, যে লোকটা প্রতিবাদ করছে, সে তো রিটার্ন-ঝাড় খেতেও রেডি থাকবে? তুমি ব্রিটিশ সরকারের বিপক্ষে বড় বড় কথা লিখলে, ব্রিটিশ সরকার তোমার বই ব্যান করবে না? তখন নাকে কাঁদলে হবে? আমরা মেয়েটার চুলের মুঠি ধরে ফুত্তি করছি, তখন তুমি আমাদের যা-তা বলতে শুরু করলে, ফিরতি-পেটান খাবে না? আমরা কি ‘হক কথা বলেছেন ভাই, এই কান মুলছি’ বলে ধুলো চাটব? না, জিভ টেনে ছিঁড়ে নেব? কোনটা ন্যাচারাল? তা হলে এত হুতোশ কেন? আর, এত হিরোগিরি দেখিয়ে কী হল? আজ কাগজে লিখছে, চ্যানেলে ডেডবডি দেখাচ্ছে, কিন্তু ষোলো মাস বাদে কী হবে? তোমার নামে একটা বাঁটকুল শহিদ বেদিতে ফুচকার শালপাতা গড়াগড়ি খাবে। অবশ্য অদ্দিন কেন, এই তো ওয়ার্ল্ড কাপ শুরু, পাকিস্তানের সঙ্গে লাস্ট ওভারে মিডিয়া তোমায় নিয়ে ট্যাঁ-ফোঁ করবে? শুধু শুধু, পয়েন্টলেস একটা কাজ করলে, হাততালির মানে কী? যুগে যুগে আমরা জিতেছি। মার্টিন লুথার কিং মরেছে, তুমিও। বুদ্ধুর দল। চালাকরা বেঁচে থাকার জন্যে অ্যাপেনডিক্স বাদ দেয়, শিরদাঁড়াও!

লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন