অধিকার বস্তুটি যে কেহ হাতে তুলিয়া দেয় না, তাহা ছিনাইয়া লইতে হয়, রাজনীতির দৌলতে পশ্চিমবঙ্গবাসী কথাটি বিলক্ষণ শিখিয়াছেন। তবে, কোনটি অধিকার আর কোনটি নহে, দেখা যাইতেছে, সেই শিক্ষাটি অসম্পূর্ণই থাকিয়া গিয়াছে। কোনও স্কুলে কে শিক্ষকতা করিতে পারিবেন আর কে পারিবেন না, তাহা স্থির করিবার অধিকার শিক্ষার্থীদের নাই। অভিভাবকদেরও নহে। সিদ্ধান্তটি কর্তৃপক্ষের। রাজ্যের প্রাইমারি স্কুলগুলির ক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষা পর্যদের। অর্ণব হালদারকে রায়দিঘির রায়মণিখাকি স্কুলে নিয়োগ করিয়াছিল পর্ষদই। টেট পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্যতা যাচাইয়ের পরই অর্ণব চাকুরি পাইয়াছিলেন। সুতরাং, তাঁহার শিক্ষকতার অধিকার লইয়া আর কোনও প্রশ্ন থাকিতে পারে না। অন্তত, তিনি কাজে যোগ দেওয়ার পূর্বে নহে। তিনি শিক্ষক হিসাবে কতখানি দড় হইবেন, তাহার কোনও হদিশ প্রতিবাদকারীদের নিকট নাই। তবুও তাঁহারা বিক্ষোভে মাতিয়াছেন। অর্ণব প্রতিবন্ধী, ইহাই অভিভাবকদের নিকট তাঁহার ‘অযোগ্যতা’-র অকাট্য প্রমাণ।
অভিভাবকদের এই অশিক্ষা, সংবেদনশীলতার এমন চূড়ান্ত অভাবকে প্রশ্রয় দেওয়ার কোনও প্রশ্নই নাই। ঘটনাটি সুতীব্র লজ্জার। তাহা দেখাইয়া দেয়, পশ্চিমবঙ্গের ন্যায় তথাকথিত প্রগতিশীল রাজ্যেও সামাজিক সচেতনতা কোন তলানিতে রহিয়াছে। আশার কথা, প্রশাসন এই অশিক্ষাকে শিরোধার্য করে নাই। স্কুল কর্তৃপক্ষ হইতে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ, জেলা শাসক— প্রতিটি স্তরেই অর্ণব সাহায্য পাইয়াছেন। দায়িত্ব অবশ্য এখানেই ফুরাইয়া যায় না। এই ঘটনাটিতে রাজ্য সরকারের কঠোর প্রতিক্রিয়া প্রয়োজন। জানাইয়া দেওয়া বিধেয়, জনমতের নামে, বা অধিকারের দোহাই দিয়া, এমন কুৎসিত আচরণ বরদাস্ত করা হইবে না। তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারাও জানাইয়াছেন, এই বিক্ষোভে তাঁহাদের সায় নাই। যদিও, বিক্ষোভকারীদের প্রথম সারিতে নাকি কিছু তৃণমূল কর্মীকে দেখা গিয়াছে। পশ্চিমবঙ্গের সমাজ অতিমাত্রায় রাজনীতিকেন্দ্রিক। ফলে যে কোনও সামাজিক ঘটনার পুরোভাগেও দলীয়— বিশেষত শাসক দলের— নেতারা থাকেন। যেহেতু বামপন্থীদের তুলনায় তৃণমূল কংগ্রেসে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ অনেকাংশে শিথিল, ফলে কোনও ঘটনায় শাসক দলের কোনও স্থানীয় নেতার উপস্থিতিকে সেই ঘটনায় দলের সমর্থনের সূচক হিসাবে দেখিলে সম্ভবত অহেতুক সরলীকরণ হইবে।
কিন্তু, দলের প্রত্যক্ষ সমর্থন থাকুক আর না-ই থাকুক, রায়দিঘির ঘটনাটি রাজনীতিরই ফসল। বামফ্রন্ট এবং তৃণমূল কংগ্রেসের অভিন্ন বামপন্থী রাজনীতিতে প্রান্তিক মানুষের ভাষা রাজনৈতিক পরিসরে পৌঁছাইতে পারিয়াছে— ইহা মস্ত লাভ। কিন্তু, সেই লাভের বিপরীত পার্শ্বে আছে একটি বিপুল বিপদ। যে কোনও ঘটনাকেই সংগঠিত ক্ষোভের আকার দিয়া তাহা হইতে রাজনৈতিক মুনাফা তুলিবার প্রবণতাটিও এই বঙ্গে মহামারীর আকার ধারণ করিয়াছে। বস্তুত, ভাঙড়ের গ্রাম সাক্ষ্য দিবে, এখন স্থানীয় ক্ষোভকে লালন-পালন করিয়া তাহাকে রাজনৈতিক বিস্ফোরক বানাইয়া তোলা পশ্চিমবঙ্গে দস্তুর হইয়াছে। কোন ক্ষোভটি ন্যায্য আর কোনটি নহে, কোন দাবিটি মানুষের অধিকারের মধ্যে পড়ে আর কোনটি অধিকার-বহির্ভূত, সেই বিচার করিবার ক্ষমতা খুচরা নেতাদের অধিকাংশেরই নাই। সময়ও নাই, সেই সচেতনতাও নাই। ফলে, রায়দিঘিতে যে উদাহরণটি মিলিল, সম্ভবত তাহাই শেষ নহে।