সম্পাদকীয়

শৌখিন বেদনা

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০১৪ ০০:০০
Share:

গাজা অঞ্চলে নিরীহ মানুষ যে ভাবে প্রাণ হারাইতেছে, তাহা গণমাধ্যমে জানিয়া বুঝিয়া কলিকাতাস্থ সাধারণ মানুষের হৃদয়ও ভারাক্রান্ত হইয়া আসিতেছে। রক্তাক্ত শিশুর চিত্র দেখিয়া অনেকেই ‘আহা রে’ বলিয়া আলোড়িত হইয়া উঠিতেছে। কিন্তু কলিকাতা শহরে, ইজরায়েলের এই হানার বিরোধী কোনও মিছিল বা অবরোধের ফলে সেই বাঙালি মানুষটির যদি অফিসে যাইতে বিলম্ব হইয়া যায়, প্রবল যানজটে বাসে ট্রামে বসিয়া দরদর ঘামিতে হয়, তখন বিরক্তিতে সে ফাটিয়া পড়িতেছে। গাল পাড়িতেছে: ‘গাজায় কী হইয়াছে না হইয়াছে তাহা লইয়া আমার কী হইবে? আমার অফিস বিপর্যস্ত করিয়া বা ছায়াছবির টিকিট নষ্ট করাইয়া এই আন্দোলনকারীদের কী লাভ হইতেছে? নিজের শহর বা রাজ্যটি কোন দশায় রহিয়াছে তাহা লইয়া ইহাদের দুশ্চিন্তা নাই, অকস্মাত্‌ গাজা লইয়া পড়িল!’ এই মতে প্রায় সকলেই তাল দিয়া থাকে। বামপন্থীগণ যখন ইরাকের শিশুদের দুগ্ধের জোগানের নিমিত্ত শ্যামবাজার মোড়ে মানববন্ধন করিতেন ও প্রত্যেক যাত্রীর জীবন দুই দণ্ডের নিমিত্ত স্তব্ধ হইয়া যাইত, তখন পতাকা-আস্ফালনকারী দলটির বিরুদ্ধে প্রবল বিষোদ্গার চলিত, অবশ্য নিম্নস্বরে। সাধারণ মানুষ চিরকালই মনে করিয়াছে, একান্ত নিজস্ব পরিমণ্ডলে যাহা ঘটিতেছে, তাহার বাহিরে অন্য কোনও বিষয়ে চিন্তিত হইয়া পড়িবার কোনও তাত্‌পর্য নাই, ইহা হয় পণ্ডশ্রম নয় আঁতলামি, মানুষের চিন্তা করা উচিত কেবল আপনি ও কোপনি লইয়া। যে কোনও প্রশ্নে অবরোধই নিত্যযাত্রীকে খেপাইয়া দেয়, আর বিক্ষোভের কেন্দ্রগত বিষয়টি এই দেশ হইতে দূরবর্তী অঞ্চলের সহিত সম্পৃক্ত হইলে সে ভাবে, ইহা কেবল অবান্তর প্রসঙ্গ টানিয়া মানুষকে অহেতুক বিড়ম্বিত করিবার শয়তানি।

Advertisement

বিশ্বায়ন আসিয়া সমগ্র বিশ্বকে একটি গ্রামে পরিণত করিয়াছে। মানুষ ভারতে বসিয়া মার্কিন সিরিয়াল দেখিতেছেন আমেরিকার সহিত একযোগে, পথেঘাটে বিদেশি গাড়ির শো-রুম আমন্ত্রণ মেলিয়া আছে। হিন্দি ছবির পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান আয়োজিত হইতেছে সপ্ত সমুদ্র পারে। সমগ্র জীবনযাত্রা ও মনোভঙ্গিতে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণি বলিতেছে, তাহার শপিং মল দুবাই বা অস্ট্রেলিয়া বা জার্মানি অপেক্ষা কোনও অংশে ন্যূন নহে, বা ন্যূন হইলে চলিবে না। সে সুবিধা ও সুযোগের ময়দানে বিশ্বনাগরিক হইয়া বিরাজ করিতে চাহে, তাহার আনন্দ ও ভোগের তার এখন আন্তর্জাতিক সুরে বাঁধা হইয়া গিয়াছে। কিন্তু সমগ্র পৃথিবীর আমোদযজ্ঞে শামিল হইবার ছাড়পত্র লাভের নিমিত্ত তাহার যে তাড়না, সমগ্র বিশ্বের বিষাদের উত্তরাধিকার লইবার ক্ষেত্রে তাহার কণামাত্র খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। তখন সে বিস্মিত হইয়া তাকাইয়া থাকে: ‘মানচিত্রের ওই প্রান্তের অঘটন লইয়া আমি ভাবিব? ইহা কেমন আবদার!’ অর্থাত্‌ সুবিধাগুলি সে লইবে ও দাবি করিবে বটে, কিন্তু অসুবিধাগুলির তাপ তাহার গাত্রে লাগিলে চলিবে না। তখন সে আন্তর্জাতিকতা অনায়াসে বিসর্জন দিয়া, হইয়া পড়িবে প্রবল প্রাদেশিক, এমনকী নিতান্ত ব্যক্তিকেন্দ্রিক, কেবল নিজ পরিসরের পাশ্ববর্তী কয়েক ইঞ্চি লইয়া ব্যস্ত। সাধারণ মানুষের এই ভণ্ডামি অশিক্ষা স্বার্থপরতাই তাহাকে সাধারণ করিয়া রাখিয়াছে। যাহাতে নিতান্তই সে জড়াইয়া আছে, তাহা ব্যতীত কোনও সমস্যা সমাধানেই সে কোনও প্রত্যক্ষ প্রয়াস করিবে না। অন্য কেহ করিলে, তাহাকে ব্যঙ্গ করিবে। আর, লক্ষ লক্ষ নিরীহ প্রাণকে দলিয়া পিষিয়া মারিতেছে যে শক্তি, মানুষকে শোষণ করিয়া ক্ষমতা কায়েম রাখিতেছে যে শক্তি, তাহার বিরুদ্ধে জনমত ও রাষ্ট্রমত গড়িয়া তুুলিবার নিমিত্ত আন্দোলনকে নিরন্তর অপমান করিয়া চলিলে যে সেই অত্যাচারী শক্তিগুলিকেই প্রকারান্তরে সমর্থন জানানো হয়, সেই কথা তাহার মস্তকে ঢুকিতে ঢুকিতে আয়ু ফুরাইয়া যাইবে। তাই সংবাদপত্র পড়িয়া সমবেদনা প্রকাশের শৌখিন ও শূন্যগর্ভ ভঙ্গিগুলি বরং সে পরিহার করিলে পারে।

Advertisement

য ত্‌ কি ঞ্চি ত্‌

যারা ইংরিজি মিডিয়ামে পড়েনি, কিন্তু আধুনিক পৃথিবীতে যৌবন কাটাচ্ছে, তারা হীনম্মন্যতার পোঁটলা তো বয়ে বেড়াচ্ছেই, ফুটবলের সাধটাও বোধহয় এ বার ভাসান গেল। ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের প্র্যাকটিসের সময় দুই স্প্যানিশ খেলোয়াড় নিজেদের মধ্যে মাতৃভাষায় কথা বলছেন দেখে নতুন কোচ ফান গল রেগে আদেশ দিলেন, সব্বাই শুধু ইংরিজিই বলবে। তার মানে, যে ঠিক করেছিল নিরক্ষর থাকবে কিন্তু তেকাঠি চিনবে, তারও স্পোকেন-ইং কোচিং-ভিজিট শুরু!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন