সম্পাদকীয় ২

শরীর বনাম মন

দে হ ও মনের দ্বন্দ্বে কে বড়? এই প্রশ্নে পক্ষাবলম্বীদের অভাব নাই। এবং তাঁহারা নিজ নিজ মতে দৃঢ় আস্থা পোষণ করেন। রোগাক্রান্ত দেহের মালিক যে সচরাচর মানসিক ভাবে অসুখী হন, তাহা না বলিলেও চলে। মন ভাল রাখিবার চেষ্টা করিলেই কোনও কোনও রোগ সারে কি না, তাহা বরং বিতর্কের বিষয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০১৫ ০০:০৯
Share:

দে হ ও মনের দ্বন্দ্বে কে বড়? এই প্রশ্নে পক্ষাবলম্বীদের অভাব নাই। এবং তাঁহারা নিজ নিজ মতে দৃঢ় আস্থা পোষণ করেন। রোগাক্রান্ত দেহের মালিক যে সচরাচর মানসিক ভাবে অসুখী হন, তাহা না বলিলেও চলে। মন ভাল রাখিবার চেষ্টা করিলেই কোনও কোনও রোগ সারে কি না, তাহা বরং বিতর্কের বিষয়। দেহ ও মনের এই দ্বন্দ্বে মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড-এর কথা আসিয়া পড়ে। মানুষ প্রবৃত্তির দাস, যুক্তির সহিত দ্বন্দ্বে প্রবৃত্তি বিজয়ীও হইতে পারে— এই মত প্রচার করিয়া একদা বিজ্ঞানী মহলে তিনি বিখ্যাত হইয়াছিলেন। অবশ্য ধর্মবিশ্বাসীদের নিন্দাও তাঁহার ভাগ্যে জুটিয়াছিল। এই অভিযোগে যে, মানুষের বাসভূমি পৃথিবীকে বিশ্বের কেন্দ্র হইতে স্থানচ্যুত করিয়া নিকোলাস কোপারনিকাস যে বিপ্লবের সূচনা করিয়াছিলেন, ফ্রয়েড নাকি তাহাতে ঘৃতাহুতি দিয়াছেন। মানুষ যদি প্রবৃত্তির দাস হয়, তাহা হইলে সে মনিব কীসের? পশুর সহিত তাহার ফারাক কোথায়? ফ্রয়েড সাহেব এ কালে বিজ্ঞানের জগতেও আর ততটা খ্যাতিমান নহেন। বস্তুবাদীরা এক্ষণে ব্যস্ত ‘কনশাসনেস’ বা চেতনার রহস্য উন্মোচনে, তাঁহারা বিশ্বাস করেন চেতনারই এক অংশ অবচেতন, আর চেতনামাত্রই অণু-পরমাণুর রাসায়নিক বিক্রিয়া। সুতরাং অবচেতন উচ্চাসনে বসিবার যোগ্য নহে, এবং ফ্রয়েড-এর তত্ত্ব ইদানীং কিছুটা গরিমাহীন।

Advertisement

সেই গরিমা বুঝিবা কিঞ্চিৎ পুনরুদ্ধার হয় এক শ্রেণির মানুষের দিকে তাকাইলে। ইংরাজিতে তাঁহাদের পরিচয় ‘ট্রান্সসেকসুয়াল’ নামে। বাঙ্গালায় প্রতিশব্দটি হইতে পারে ‘লিঙ্গভেদী’। অর্থাৎ যাহারা দেহে নর, মনে নারী। কিংবা দেহে নারী, মনে নর। দেহ আর মন যে সর্বদা সমগামী নহে, তাহা ওই লিঙ্গভেদীরা প্রমাণ করেন। বেশভূষা অথবা চালচলনে তাঁহারা ঘোষণা করেন এক সত্য। জন্মসূত্রে যে লিঙ্গ তাঁহারা অর্জন করিয়াছেন, তাহাতে তাঁহারা সন্তুষ্ট নহেন। বিপরীত লিঙ্গ অর্জনে তাঁহারা বদ্ধপরিকর। এই বাসনা অসহিষ্ণু সমাজ ভাল চোখে দেখে না। ফলে ওই সব লিঙ্গভেদীরা বিদ্রুপের শিকার। সমাজের এই অসহিষ্ণুতা আসলে এক ধরনের বিদ্রোহ দমনের বাসনা। সে অন্য কথা। তবে আচরণে বিদ্রোহ ঘোষণা করিয়া লিঙ্গভেদীরা প্রমাণ করেন এক গূঢ় সত্য। দেহ অপেক্ষা মন বেশি বলবান।

লিঙ্গভেদীদের মনোবাসনা লিঙ্গান্তর। দেহকে উপেক্ষা করিয়া মন যে লিঙ্গে চিহ্নিত হইতে চাহে, তাহা অর্জন। কাজটি জটিল, এবং সে কারণে ব্যয়সাধ্য। নরদেহের সমস্ত লক্ষণগুলি মুছিয়া নারীদেহের অঙ্গগুলি অর্জন করিতে— অথবা উলটা প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করিতে— পর পর বহু শল্যচিকিৎসার প্রয়োজন। এ দিকে এই লিঙ্গভেদীদের অনেকেই অর্থনৈতিক বিচারে দুর্বলতর শ্রেণিভুক্ত। এমত পরিস্থিতিতে লিঙ্গভেদীদের সাহায্যার্থে কেন্দ্রীয় সরকার আগ্রহী। সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশনে একটি বিল আনা সরকারের অভিপ্রায়। বিলটিকে লিঙ্গভেদীদের জন্য উন্নত সরকারি হাসপাতালে লিঙ্গবদলের উপযোগী শল্যচিকিৎসার ব্যবস্থা রাখিবার কথা বলা হইয়াছে। এ ছাড়া সরকার ওই চিকিৎসার ব্যয় বহনেও আগ্রহী। লিঙ্গভেদীদের সমস্যাকে যথার্থ গুরুত্ব দেওয়ার জন্য সরকারের সাধুবাদ প্রাপ্য। কিন্তু, তাহার জন্য সরকারকে কেন অস্ত্রোপচারের ব্যয় বহন করিতে হইবে? লিঙ্গভেদীদের আর্থিক দুরবস্থাও অর্থসাহায্যের যথেষ্ট কারণ নহে। সামাজিক ক্ষেত্রে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। সরকার বরং সেই দিকে মন দিক।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন