মায়ানমার সরকার ২০৯ জন রোহিঙ্গা মুসলিমকে নাগরিকত্ব দিবার কথা ঘোষণা করিয়াছে। দুই বছর আগের জাতিদাঙ্গায় উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের শরণার্থী শিবির হইতে এই কয় জনকে বাছা হইয়াছে। যেখানে সারা দেশে অন্তত ৮ লক্ষ রোহিঙ্গা বসবাস করেন, তাইল্যান্ড ও বাংলাদেশের উদ্বাস্তু শিবিরে আরও কয়েক লক্ষ, সেখানে মাত্র ২০৯ জনকে নাগরিকত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত আপাতদৃষ্টিতে হাস্যকর। কিন্তু ১৯৮২ সাল হইতে নাগরিকত্ব হারানো রোহিঙ্গাদের বর্তমান অসহায়তা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের হাতে তাঁহাদের ধারাবাহিক নির্যাতন ও বঞ্চনার কথা মাথায় রাখিলে এই সূচনাটিকে স্বাগত না জানাইয়া উপায় নাই। বিশেষত যখন মায়ানমার সরকারের মতে রোহিঙ্গারা বিদেশি অর্থাৎ বাংলাদেশি, নাগরিকত্ব পাইতে হইলে তাহাদের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের আগমনের আগে কয়েক পুরুষ ধরিয়া ব্রহ্মদেশে বসবাসের লিখিত প্রমাণপত্র হাজির করিতে হইবে।
সহায়সম্বলহীন, তাড়া-খাওয়া দরিদ্র মানুষের পরিচয়পত্র বা লিখিত প্রমাণপত্র থাকে না। তাই মায়ানমার সরকার আসলে তাহার এই সিদ্ধান্তের দ্বারা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী রূপে শনাক্ত করিতেই অধিক আগ্রহী। বস্তুত, ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটিতেই সরকারের আপত্তি। নাগরিকত্ব পাইতে হইলে এই জনসম্প্রদায়কে নিজেদের ‘বাঙালি’ বলিয়া শনাক্ত করিতে হইবে, এমনই সরকারের দাবি। স্বভাবতই রোহিঙ্গা মুসলিমদের নেতারা সরকারের এই সিদ্ধান্ত মানিতে অসম্মত। তাঁহাদের কাছে জাতি-সম্প্রদায়গত আত্মপরিচয় মূল্যবান। কিন্তু ত্রাণ-শিবিরে বৌদ্ধ জঙ্গিদের ঘেরাওয়ের মধ্যে কার্যত বন্দি অসহায় রোহিঙ্গা পরিবারগুলির কাছে খাদ্য-বস্ত্র-আবাসন ও চিকিৎসার চাহিদা পূরণ আত্মপরিচয় অপেক্ষা অধিক জরুরি। তাই ইতিপূর্বে জনগণনার সময় তাঁহারা নিজেদের রোহিঙ্গা পরিচয় উল্লেখ করিয়া নাগরিকত্ব হারাইলেও এক্ষণে বাঙালি হিসাবে শনাক্ত হইতে অসম্মত নন। মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের এই অসহায়তারই সুযোগ লইয়া নাগরিকত্বের টোপ দিয়া একটি গোটা জনসমাজের পরিচয় বদলাইয়া দিতে উদ্গ্রীব।
বাংলাদেশ সফর কালে মায়ানমারের বিদেশমন্ত্রী কক্স বাজারের ত্রাণ-শিবিরে বসবাসকারী ৩২ হাজার রোহিঙ্গাকে দুই মাসের মধ্যে দেশে ফিরাইয়া লওয়ার আশ্বাস দিয়াছেন। এই সবই আশার কথা। কিন্তু মুসলিম বাংলাভাষীদের প্রতি মায়ানমারে এত কাল ধরিয়া বৈষম্য, বঞ্চনা ও নিপীড়ন চলিতে পারিয়াছে, তাহার কারণ সামরিক একনায়কতন্ত্র, যাহা যাবতীয় গণতান্ত্রিক আন্দোলন নির্মম ভাবে দমন করিয়াছে এবং বিভিন্ন জনজাতীয় গোষ্ঠীর আত্মশাসনের দাবিতে মুখর সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকেও বন্দুক-কামান দিয়া জবাব দিয়াছে। বর্তমান সামরিক শাসকদের আপেক্ষিক উদারতা গণতান্ত্রিক নেত্রী আঙ সান সু চিকে মুক্তি দিয়াছে, তাঁহার অনুগামীদেরও দফায়-দফায় কারামুক্ত করিয়াছে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা অংশত ফিরাইয়া দিয়াছে। কিন্তু বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদের উগ্র রূপটি এখনও বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার শিরোধার্য করিতে চাহে না। এ জন্য রোহিঙ্গা-অধ্যুষিত আরাকান প্রদেশের নাম পর্যন্ত পাল্টাইয়া তাহাকে ‘রাখিন’ করা হইয়াছে। কিন্তু রোহিঙ্গা মুসলিমদের স্বতন্ত্র আত্মপরিচয় ও তাহার ভিত্তিতে নাগরিকত্ব অর্জনের দাবিটি ক্রমেই আন্তর্জাতিক জনমতের অনুমোদন লাভ করিতেছে। মায়ানমার তাই এই পথে আরও অগ্রসর হওয়ার সাহস দেখাইলেই মঙ্গল।