সম্পাদকীয় ২

স্বাস্থ্য ভাল নাই

স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধন নিজ ওয়েবসাইটে বলিলেন, বিদ্যালয়ে যৌনশিক্ষা নিষিদ্ধ করা উচিত। ইহার পূর্বে তিনি বলিয়াছেন, এড্স প্রতিরোধে কন্ডোম অপেক্ষা অধিক কার্যকর যৌন আনুগত্য: নিজ যৌন সঙ্গীর প্রতি বিশ্বস্ততা। এই এক আশ্চর্য, এই দেশের মন্ত্রী-সান্ত্রিরা যৌনতাবিরোধিতাকে ভারতীয় ঐতিহ্যের সহিত মহা-সমঞ্জস ব্যবহার বলিয়া ঠাওরাইয়া লন। একদা ভারত ‘কন্ডোম’ উচ্চারণ করিতেই লজ্জায় মরিয়া যাইত, আজ এড্স আসিয়া তাহাকে বারংবার ওই শব্দ ব্যবহার করিতে, এমনকী দ্রব্যটিকে কাঙ্ক্ষণীয় বলিয়া জনগণের নিকট উপস্থাপিত করিতে বাধ্য করিয়াছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০১৪ ০০:০২
Share:

স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধন নিজ ওয়েবসাইটে বলিলেন, বিদ্যালয়ে যৌনশিক্ষা নিষিদ্ধ করা উচিত। ইহার পূর্বে তিনি বলিয়াছেন, এড্স প্রতিরোধে কন্ডোম অপেক্ষা অধিক কার্যকর যৌন আনুগত্য: নিজ যৌন সঙ্গীর প্রতি বিশ্বস্ততা। এই এক আশ্চর্য, এই দেশের মন্ত্রী-সান্ত্রিরা যৌনতাবিরোধিতাকে ভারতীয় ঐতিহ্যের সহিত মহা-সমঞ্জস ব্যবহার বলিয়া ঠাওরাইয়া লন। একদা ভারত ‘কন্ডোম’ উচ্চারণ করিতেই লজ্জায় মরিয়া যাইত, আজ এড্স আসিয়া তাহাকে বারংবার ওই শব্দ ব্যবহার করিতে, এমনকী দ্রব্যটিকে কাঙ্ক্ষণীয় বলিয়া জনগণের নিকট উপস্থাপিত করিতে বাধ্য করিয়াছে। কিন্তু রাষ্ট্রের বিজ্ঞাপন ও রাষ্ট্রের মনোভাব সদা সমার্থক নহে। সাধারণ ভারতীয় মনুষ্য টিভিতে স্যানিটারি ন্যাপকিনের বিজ্ঞাপন দেখিলে অস্বস্তিতে কাশিতে থাকেন। ফলে কন্ডোম ব্যবহারের তুলনায় এই দেশের মন্ত্রী একগামিতাকে প্রাধান্য দিবেন, স্বাভাবিক। অবশ্য পরামর্শটি হাস্যকর, কারণ যৌন সঙ্গী বিশ্বস্ত আছেন কি না, তাহা জানিবার কোনও নিশ্চিত উপায় নাই। আর মারণ-রোগের প্রতিষেধক হিসাবে অন্যের মৌখিক আশ্বাসকে বিশ্বাস করিবার নিদান কোনও বুদ্ধিমান রাষ্ট্র দিতে পারে না। কিন্তু তাহা অপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ: প্রত্যেক মানুষের নিজ ইচ্ছা ও পছন্দ অনুযায়ী যৌনতার পূর্ণ অধিকার রহিয়াছে, কেহ বহুগামী হইতেই পারেন। তাহাকে সরকারি ভাবে নিরস্ত করিবার প্রয়াস নিতান্তই ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিপন্থী। অনেকে বলিয়াছেন, এই মতামত মন্ত্রিমহোদয়ের ব্যক্তিগত। কিন্তু মন্ত্রী যদি ব্যক্তিগত ভাবে রক্ষণশীল মতামত পোষণ করেন, তাহা রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণে ছাপ ফেলিবে, ইহাই স্বাভাবিক। ইহাকে লোকে রাষ্ট্রের মতামত বলিয়াও ধরিয়া লইতে পারে। সর্বোপরি, ইহা ভুল সংকেত।

Advertisement

বিদ্যালয়ে যৌনশিক্ষা লইয়া বহু ঝঞ্ঝাট পূর্বেও হইয়াছে। শিক্ষক সংগঠন আন্দোলন করিয়া এই শিক্ষা বন্ধ করিয়াছেন, কারণ ‘এই সকল’ শিখাইলে অপাপবিদ্ধ কিশোর-কিশোরীগণের হৃদয়ে অশ্লীল চিন্তা সঞ্চারিত হইবে। আসলে, যৌনতাকে জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য, স্বাভাবিক ও আনন্দময় অঙ্গ হিসাবে না দেখিতে পারিলে এই ধরনের ধারণা বাসা গাড়িতে বাধ্য। যৌনতা একটি ঘৃণ্য কাণ্ড, যাহা প্রজাবৃদ্ধির জন্য মানিয়া লইতেই হইতেছে, এমন মনোভাব হইতেই যৌনশিক্ষা-বিরোধী মতামতের জন্ম। অথচ কিশোরকিশোরীরা জৈব প্রবণতা অনুযায়ীই তাহাদের নিজ দেহ ও মনে পরিবর্তনের ফলে যৌনতা-সংক্রান্ত কৌতূহল পোষণ করিতেছে। কিন্তু উত্তরের পরিবর্তে প্রাপ্তবয়স্কদের রক্তচক্ষু ও ঢাকঢাক-গুড়গুড় দেখিয়া এই সুস্থ অনুসন্ধিৎসাকে পাপ বলিয়া ভাবিতেছে, অপরাধবোধে ভুগিতেছে। আবার ইহার-তাহার নিকট হইতে আংশিক, বিকৃত ও ভুল তথ্য জানিয়া, বিপদেও পড়িতেছে। যৌনশিক্ষার নাম জীবনশৈলী দিয়াও পার পাওয়া যায় নাই, ভারতীয় ভণ্ডামি সমানে এক দিকে তীব্র যৌন-ক্ষুৎকাতরতা ও অন্য দিকে শাক দিয়া আনন্দ ঢাকিবার প্রক্রিয়ায় এই জরুরি পাঠ্যক্র্রমটিকে কর্তন করিয়াছে। শিক্ষিত ও জাগ্রত জীবন যাপনের তুলনায় অশিক্ষিত অসচেতন দিনক্ষয়কে কাম্য বলিয়া মনে করেন এই দেশের অধিকাংশ গুরুঠাকুর। ইঁহাদের পাওয়া যাইবে কেবল হিন্দুত্ববাদী দলে নহে, সর্ব দলে, সর্ব মতের সংগঠনে। অধিক স্বাধীনতায় মানুষ বখিয়া যায়, তাই তাহার সত্তায় কিঞ্চিৎ রজ্জু আঁটিলে সমাজের স্বাস্থ্য মোটের উপর ভাল থাকিবে, এই মতে ইঁহারা সকলেই টিপছাপ দিয়াছেন। স্বাধীনতা ও প্রকৃত প্রগতির তরঙ্গোচ্ছ্বাসকে ইঁহারা ভয় পান, কারণ তাহা বহু ভাবনা ও তর্কের জন্ম দেয়, কূপের অন্ধকার তাহা অপেক্ষা অধিক স্বস্তিময়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement