প্রবন্ধ ১

সুবনসিরির দেশে

ও পারে হান-চিনাদের হুঙ্কারে স্থানীয় সংস্কৃতি লোপাট হওয়ার জোগাড়। এ পারে কিন্তু অরুণাচলে আজও ৫০ রকম ভাষা, ২৫ রকম জনজাতি।আমাদের রাষ্ট্রনেতারা শুধু শুধুই চিন নিয়ে চিন্তিত হন। ভারতের লোককথার বীরেরা অনেক দিন আগেই ড্রাগনকে পরাস্ত করেছেন। চলেছি অরুণাচল প্রদেশের দাপরিজো শহরে। জঙ্গুলে রাস্তা, পাশে বয়ে চলেছে চিন থেকে আসা সুবনসিরি নদী। আচমকা গ্রামের মাঠে কালো পাথরের মূর্তি।

Advertisement

গৌতম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০০
Share:

ছবি: প্রদীপ্ত বাগচি।

আমাদের রাষ্ট্রনেতারা শুধু শুধুই চিন নিয়ে চিন্তিত হন। ভারতের লোককথার বীরেরা অনেক দিন আগেই ড্রাগনকে পরাস্ত করেছেন। চলেছি অরুণাচল প্রদেশের দাপরিজো শহরে। জঙ্গুলে রাস্তা, পাশে বয়ে চলেছে চিন থেকে আসা সুবনসিরি নদী। আচমকা গ্রামের মাঠে কালো পাথরের মূর্তি। ড্রাগন কামড়ে ধরেছে মিথুনের ঘাড়। পাশে গ্রিক বীরের মতো এক যুবক, হাতের তরবারি ড্রাগনের ঘাড়ে। মূর্তির নীচে রোমান হরফে লেখা ‘আতো টোপো জিসু পান লিগু টিটু’। তাগিন জনজাতির ভাষা। এঁদের লিপি ছিল না, তাই রোমান হরফ। বাক্যের অর্থ: আতো টোপো মিথুনভক্ষণে উদ্যত ড্রাগন বধ করেছিলেন।

Advertisement

এর দিন কয়েক পরে সুবনসিরির স্রোত বেয়ে পৌঁছেছিলাম জিরো শহরে। বাজারে ঢেলে বিক্রি হচ্ছে এক ধরনের সবুজ পোকা, তিনশো টাকা কেজি। হালকা গরম জলে সিদ্ধ করে ভেজে নিলে চমত্‌কার খেতে। পাশে কাঠিতে গাঁথা ঝলসানো জংলি ইঁদুর। প্রতি কাঠি তিরিশ টাকা। লোকে তবু বলে, চিনারাই শুধু ইঁদুর, পোকা খায়!

অরুণাচল প্রদেশ তা হলে মানচিত্রে ভারতীয় এবং সংস্কৃতিতে চিনের কাছাকাছি? তা হলে ইনকিয়ং-এর রাস্তায় ‘ডোনি পোলো’র নামলো বা মন্দিরটিকে বুঝব কী ভাবে? চিন থেকে আসা সিয়াং নদীর ওপর বাঁশ আর বেতের তৈরি সেতু, জোরে হাওয়া বইলে বিপজ্জনক ভাবে দুলতে থাকে সেই সেতু, পায়ের নীচে কাঠের পাটাতন। এলাকায় মুখ্যত আদি এবং গালে জনজাতির বাস। তাঁদের বিশ্বাস, ডোনি পোলো বা সূর্য এবং চন্দ্র থেকেই পৃথিবীর সব জীবের উত্‌পত্তি। সেতু পেরিয়ে সেই মন্দিরে উঁকি দিয়ে দেখলাম, ভিতরে নীল আকাশের ক্যানভাসে সূর্য ও চন্দ্রের ছবি। ছেঁড়া ছেঁড়া দৃশ্যগুলিই বুঝিয়ে দেয়, চিন এবং মায়ানমার সীমান্তে স্বাধীন ভারত নিঃশব্দে একটি যুদ্ধে জিতে গিয়েছে। মায়ানমারের পাহাড়ে কাচিন এবং শান জনজাতির অভিযোগ, ইয়াঙ্গন এবং ম্যান্ডালের লোকেরা তাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতি রাখতে দেয়নি, শুধুই সেনা-অভিযান চালিয়েছে। হান-চিনাদের হুঙ্কারে তিব্বতের ভাষাসংস্কৃতি বহু দিনই বিপন্ন। অথচ, অরুণাচলে এখনও টিকে আছে প্রায় ৫০ রকম ভাষা। ঘরদোর, ধর্ম, ভাষা, খাদ্য এবং সামাজিকতার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রায় ২৫ রকমের প্রধান জনজাতি। জাতীয়তাবাদী রণহুঙ্কার নয়, জনজাতিদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যসহ বাঁচিয়ে রাখার যুদ্ধে এ পারে ভারতই এগিয়ে।

Advertisement

এই ন্যায়যুদ্ধের রচনাকার গাঁধীবাদী এক ইংরেজ নৃতাত্ত্বিক: ভেরিয়ের এলউইন। ভারতীয় নাগরিকত্ব নেওয়া মানুষটির মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর হল এ বার। তাঁর নিজের ইচ্ছায় অরুণাচলের খরস্রোতা সিয়াং নদীতেই ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁর চিতাভস্ম। চিন-ভারত যুদ্ধের ঢের আগে ১৯৫৪ সালে নেহরু তাঁকে সরকারের নৃতত্ত্ববিষয়ক পরামর্শদাতা নিযুক্ত করেন। আজকের উত্তর-পূর্ব ভারতের জনজাতি সংক্রান্ত বহু পরিকল্পনাই নেহরু-এলউইন জুটির সৃষ্টি। এলউইনের মত ছিল, ১) গাঁধীর মদ্যপান বিষয়ক নিষেধাজ্ঞা উত্তর-পূর্বে কার্যকর করা যাবে না। আপাং বা রাইস বিয়ার উপজাতিরা শুধু নেশার জন্য খান না। এটি তাঁদের সামাজিক ঐতিহ্য। ২) খাদির প্রবর্তন চলবে না। বরং আদিবাসীদের নিজস্ব বয়নশিল্পকে উত্‌সাহ দিতে হবে।

তিন সপ্তাহের সফরে অনেক রকম ‘আইএলপি’ বা ইনার লাইন পারমিট করাতে হয়েছিল। আজকাল অনেকেরই প্রতিবাদ শুনি, নিজের দেশে পারমিট করাতে হবে কেন? গণতান্ত্রিক দেশে আমার যেখানে খুশি যাওয়ার অধিকার আছে! অরুণাচলের জনজাতি এলাকায় ইনার লাইন পারমিট কিন্তু শুরু হয়েছিল ১৮৭৩ সালে। তার আগে ইংরেজ কোম্পানি ও দেশীয় ভদ্রলোকেরা জনজাতি এলাকায় যথেচ্ছ জমি ও জঙ্গল দখল করে সাঁওতাল বিদ্রোহ ঘটিয়েছিল। অসমের ব্রিটিশ প্রজারা যাতে চা-বাগান বাড়ানোর অজুহাতে জনজাতি এলাকায় জমি দখল না করতে পারে, সে কারণেই অনুমতির বাঁধন। নেহরু-এলউইন জুটির অন্যতম দূরদর্শিতা, শত প্ররোচনাতেও ভিক্টোরীয় আমলের এই ইনার লাইন পারমিট বন্দোবস্ত টিকিয়ে রাখা। নইলে উত্তর-পূর্ব ভারতে সংস্কৃতির বৈচিত্র কবেই নষ্ট হয়ে যেত!

আপাতানি জনজাতির বিয়েতে রাইস-বিয়ার খেলাম। মিসিং জনজাতির বাঁশের তৈরি কুঁড়েঘরে গৃহকর্তা কাঁসার বাটিতে সাদা আপাং দিয়ে জানালেন, প্রথমে একটু মাচার নীচে ঢেলে দিন। এই ভাবে আমরা ডোনি পোলোকে উত্‌সর্গ করি। মিসিং, গালো, মিসমি জনজাতির মেয়েরা ঘরে বসে বুনছেন তাঁদের নিজস্ব কারুকৃতিঋদ্ধ পোশাক। এলউইন, নেহরু আর পৃথিবীতে নেই। কিন্তু উত্তর-পূর্ব ভারতে রয়ে গিয়েছে তাঁদের দূরদর্শী নীতি। নেহরুর বক্তব্য ছিল, এই জনজাতিদের মিউজিয়াম স্পেসিমেন হিসেবে দেখা যাবে না। আবার ঐতিহ্য ভুলিয়ে বল্গাহীন প্রগতির রথে সওয়ার করাও উচিত নয়। মধ্যপন্থা নিয়ে রাস্তাঘাট স্কুল হাসপাতাল করতে হবে। পাশাপাশি জনজাতির ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখায় উত্‌সাহ দিতে হবে। ‘এই জনজাতিদের আমাদের সেকেন্ড রেট কপি বানিয়ে লাভ নেই,’ লিখছেন নেহরু।

অথচ নিজেদের জেরক্স দেখতে না পেলে আমরা কী আতঙ্কে ভুগি! ছবি তুলতে গেলে প্রশ্ন: কোত্থেকে এসেছেন? এখানে দেখার কী আছে? এক গাঁওবুড়ো বললেন, ‘ভদ্রতা জানেন না? কী ছবি তুলছেন, দেখান!’ নাগরিক ভব্যতা, ব্যক্তিগত পরিসর ভেঙে চুরমার। সঙ্গীরা ভয়ার্ত, এরা তো দেখছি প্রায় গুন্ডার ঢঙে কথা বলে! তাগিন জনজাতির এক গাঁওবুড়োর সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছি। তাঁর জামাই হাসছিলেন, ‘বুড়োর দুটো বিয়ে, অথচ রোজ আমাকে বিরক্ত করে মারে: তুই তো অসমে থাকিস, একটা মেয়ে দেখে দে।’ জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এখানে বহুবিবাহ চলে নাকি? কটা বিয়ে করা যায়?’ গাঁওবুড়োর সাফ জবাব, ‘আপনার যেমন ক্ষমতা।’

এক আপাতানি গ্রামে বিয়েবাড়িতে গিয়েছিলাম। কুয়াশামাখা ভোরে মেয়েরা লাইন বেঁধে চলেছে। মাথায় বাঁধা বেতের ঝুড়িতে সদ্য কাটা ধান: উপহার হিসেবে। বর-কনের ছয় মাসের সন্তান রয়েছে। লিভ-ইন পর্বের পর, ফসল ওঠার অবসরে এখন বিয়ে। ‘ভালবেসে দু’ জনে একসঙ্গে থাকে। বিয়ের অনুষ্ঠান যখন ইচ্ছা করবে, সমাজ মাথা ঘামাবে কোন দুঃখে’, বললেন এক জন। মেচুকা, ইনকিয়ং-এ লোকে কাঁধে ছররা বন্দুক, হাতে গুলতি, কোমরে দা নিয়ে শিকারে যাচ্ছে। নাগরিক সংরক্ষণের ধারণা গুটিয়ে জড়োসড়ো। এ দিকে চোরাশিকার, কাঠ পাচারের গল্প নেই। অরুণাচলে ফরেস্ট কভার ৮০ শতাংশের উপর।

আসলে দুটো ভাষা দু’রকম। মেনস্ট্রিম ভারত নাগরিকত্ব, ব্যক্তিগত পরিসরের কথা বলে। অরুণাচল কমিউনিটি বা সম্প্রদায়ের কথাও জুড়ে দেয়। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কে রাঢ়ী আর কে বারেন্দ্র জানতে গেলে সবাই আপনাকে সংস্কারাচ্ছন্ন বলে দুয়ো দেবে। অথচ অরুণাচল অক্লেশে জানিয়ে ও বুঝিয়ে দেয়, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী নবম টুকি নিশি জনজাতির। আগে দোরজে খাণ্ডু ছিলেন মনপা। বিজেপি, কংগ্রেস, তৃণমূল তিনটি দলই আছে। কিন্তু ভোট শুধু জাতপাত-ধর্মের ভিত্তিতে হয় না। এক মিসমি গাঁওবুড়োকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আপনার প্রতিবেশী যুবক তো খ্রিস্টান! একঘরে করেননি?’ তিনি অবাক হয়ে বললেন, ‘কেন? ওর ছেলে ইচ্ছে হলে ফের ডোনি পোলোর ধর্মে চলে আসতে পারে। গাঁয়ে ঘুরলে দেখবেন, অনেকে আজকাল হিন্দু, বৌদ্ধও হচ্ছে। কিন্তু মিসমি তো বটে!’

এর পরও বলব, আমরা আলোকপ্রাপ্ত আর নর্থ ইস্টের জনজাতিরা অন্ধকারাচ্ছন্ন?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন