সম্পাদকীয় ১

সামান্য লাভ

অতি বিলম্বে অতি অল্প হইল। অবশ্য ‘হইতে পারে’ বলাই সঙ্গত। সরকারি নীতিতে ঘোষিত লক্ষ্যগুলির অতি সামান্যই কাজে পরিণত হয়। ব্যর্থতাগুলি কয়েক বৎসর পরে নূতন নীতিতে নূতন আশ্বাস হইয়া ফিরিয়া আসে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৭ ০০:০০
Share:

অতি বিলম্বে অতি অল্প হইল। অবশ্য ‘হইতে পারে’ বলাই সঙ্গত। সরকারি নীতিতে ঘোষিত লক্ষ্যগুলির অতি সামান্যই কাজে পরিণত হয়। ব্যর্থতাগুলি কয়েক বৎসর পরে নূতন নীতিতে নূতন আশ্বাস হইয়া ফিরিয়া আসে। জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি (২০১৭) লইয়া তেমনই করুণ কৌতুক চলিতেছে। ২০০২ সালের জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি প্রসূতিমৃত্যু কমাইবার যে লক্ষ্য স্থির করিয়াছিল, তাহা অধরা রহিয়াছে। এই ২০১৭ সালে ফের একই লক্ষ্য (১ লক্ষ প্রসবে ১০০ মৃত্যু) স্থির করিয়াছে নূতন স্বাস্থ্য নীতি। কুষ্ঠ, কালাজ্বর, ফাইলেরিয়া, এই সংক্রামক অসুখগুলি ২০০২ সালের স্বাস্থ্য নীতির পরিকল্পনা অনুসারে এতদিনে নির্মূল হইবার কথা ছিল। কোনওটাই বিদায় হয় নাই, অতএব নূতন নীতি এগুলি নির্মূল করিবার নূতন লক্ষ্য স্থির করিয়াছে। প্রসঙ্গত, ভারতে প্রথম স্বাস্থ্য নীতি ঘোষিত হয় ১৯৮৩ সালে। তাহাতে বলা হইয়াছিল, ২০০০ সালের মধ্যে সকল শিশুর জন্ম হইবে প্রশিক্ষিত কর্মীর উপস্থিতিতে। আজও সে লক্ষ্য পূরণ হয় নাই। এখনও সিকিভাগ প্রসূতিরই প্রসবের সময়ে সহায়তা মেলে না হাসপাতাল বা প্রশিক্ষিত ধাত্রীর। সরকারের সহিত দেশের নাগরিকের এমন কানামাছি খেলা চলিতেছে, সংসদ হইয়া উঠিয়াছে তাহার মঞ্চ। মন্ত্রীদের ঝনঝন-খনখন ভাষণে চমৎকৃত দেশবাসী মোহিত হইয়া সরকারের জয়ধ্বনি দিবে, অপরূপ ভবিষ্যতের ছবি দেখিতে দেখিতে বাস্তব চিত্রকে তুচ্ছ জ্ঞান করিবে, গণতন্ত্রে ইহা পরিচিত খেলা। খানিক বুঝিয়া-শুনিয়াই নাগরিক এই ভুলিয়া থাকিবার খেলায় যোগ দেন।

Advertisement

কিন্তু হায়, সেই কল্পিত স্বাস্থ্যসমৃদ্ধির ছবিটিও এ বার চাকচিক্যহীন। ২০২৫ সালের জন্য গড় আয়ুর যে লক্ষ্য বাঁধিয়াছে সরকার, সেই ৭০ বৎসরের আয়ুর লক্ষ্যে ইতিমধ্যেই পৌঁছাইয়া গিয়াছে বাংলাদেশ। নবজাতক মৃত্যুর যে হার ভারতের নূতন স্বাস্থ্য নীতির লক্ষ্য, শ্রীলঙ্কায় এখনই ওই হার তাহার চাইতে কম। প্রতিবেশী, দরিদ্রতর দেশগুলির কাছাকাছি পৌঁছাইতে আরও পাঁচ-ছয় বৎসর লাগিয়া যাইবে ভারতের, ইহাই ঘোষিত হইল এ বৎসর। ইহাতে নূতন উৎসাহ জাগিবার পরিবর্তে পুরাতন সংশয় আসিয়া আচ্ছন্ন করিবে না কি? সেই সংশয় এই যে, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং অন্যান্য সামাজিক উন্নয়নের খাতে অর্থব্যয়ে নরেন্দ্র মোদীর সরকার বরাবরই কৃপণ। পরপর কয়েক বৎসর বাজেটে যা বরাদ্দ হইয়াছে, তাহা দেখিলে স্পষ্ট হয় যে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ গোড়ায় কমাইয়া, পরে অল্প অল্প করিয়া বাড়ানো হইয়াছে। মূল্যবৃদ্ধি বাদ দিয়া দেখিলে কার্যত ২০১১-১২ সালের পরে স্বাস্থ্যের খাতে বরাদ্দ বিশেষ বাড়ে নাই। সদিচ্ছা থাকিলে এত দিনে সরকার বরাদ্দের হার ক্রমে ক্রমে বাড়াইতে পারিত। জাতীয় উৎপাদনের আড়াই শতাংশ বরাদ্দ করিতে নূতন নীতির প্রয়োজন হইত না।

সরকার আস্ফালন করিতে পারে, নীতির লক্ষ্য পূরণ হইলে স্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ দ্বিগুণেরও অধিক হইবে। দুঃখের বিষয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে মোট জাতীয় উৎপাদনের আড়াই শতাংশ বরাদ্দ যথেষ্ট নহে, তাহা ন্যূনতম প্রয়োজনের অর্ধেক। উন্নত দেশগুলি দশ শতাংশের অধিক খরচ করে স্বাস্থ্যের জন্য। লাতিন আমেরিকা এবং আফ্রিকার অধিকাংশ দেশেও স্বাস্থ্যের খাতে বরাদ্দ ইহার অধিক। মন্দের ভাল, ভারতের নূতন নীতি প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর জোর দিয়াছে। বাড়তি বরাদ্দের অধিকাংশ প্রাথমিক স্বাস্থ্যে খরচ হইবে। গ্রামের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে বিনা পয়সায় পরীক্ষা, চিকিৎসা, ঔষধ মিলিবে, ইমার্জেন্সি পরিষেবা এবং যথেষ্ট শয্যাও প্রাথমিক স্তরে মিলিবে, এমনই লক্ষ্য নির্ধারণ করিয়াছে স্বাস্থ্য নীতি। উত্তম প্রস্তাব, কিন্তু যথেষ্ট প্রশিক্ষিত চিকিৎসক ও কর্মী মিলিবে কি? সর্বাঙ্গীণ পরিকল্পনা না করিয়া লক্ষ্য ঘোষণা করা নেতাদের পুরাতন রোগ। তাহার চিকিৎসা করিবে কে?

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন