মা বললেন, ‘ছেলে যে এত কিছু শিখেছে খেয়ালই করিনি।’ মায়ের গলায় আবেগ, চোখের কোণে জল। খেয়াল করার কথাও নয় তাঁর। বরাবর জেনে এসেছেন, দেখে এসেছেন, স্কুল মানে শুধুই পড়া। স্কুল থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফেরার পথে টিউশন। টিউশনে গেলে স্কুলের হোম টাস্কের সমাধান হবে, কিন্তু সেখানেও মিলবে হোম টাস্ক। তাই ঝোলা কাঁধে বিধ্বস্ত শিশুটি যখন বাড়ি ফেরে, তখন আর তার খেলার, গল্পের বই পড়ার অথবা গান গাওয়ার অবস্থাই থাকে না। কেতাবি দুনিয়ায় আছে অনেক ভাল কথা, জাতীয় পাঠ্যক্রম পরিকাঠামো, শিশুর অধিকার ইত্যাদি, কিন্তু বাস্তবে তোতাকাহিনি আগের মতোই প্রাসঙ্গিক। শৈশব কি তবে বইয়ে মুখ গুঁজেই কেটে যাবে? চিনা প্রবাদ আছে, একশো পাতা পড়ে যে জ্ঞান অর্জন হয়, তার চেয়ে বেশি জ্ঞান অর্জন করা যায় একশো পা পথ চললে। সে পথে আমরা শিশুদের কোনও দিনই চলতে দেব না?
এই প্রশ্নের তাড়নাতেই যেন স্বরূপনগর ও স্বরূপনগর-উত্তর চক্রের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা খুঁজে চলেছেন শিশুদের আরও ভাল করে পড়াবার নতুন নতুন পথ ও পাথেয়। এই খোঁজ থেকে তাঁদের আয়োজন ‘শিশুমেলা’। কয়েকশো প্রাথমিক স্কুলের শিশুদের মিলনোৎসব। উত্তর চব্বিশ পরগনার স্বরূপনগর চক্রের শিক্ষকদের উদ্যোগে, শিক্ষা কর্তৃপক্ষের সহায়তায় সেপ্টেম্বরে দু’দিনের মেলা হল। দেখে আপ্লুত জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিষদ সভাপতির ফরমান, আগামী বছরের মেলা যেন হয় আরও অনেক বড়, আসে যেন প্রতিটি স্কুলের সব পড়ুয়া। অবর পরিদর্শকও গর্বিত।
নতুন কিছুর খোঁজ শুরু হয়েছিল স্কুলে গানবাজনা, নাটক, দেওয়াল পত্রিকা ইত্যাদির মাধ্যমে, এ বার যোগ হল এই উদ্যোগ। দুই চক্রের ১৪৪টি স্কুলের শিশুদের এক জায়গায় নিয়ে আসা, পরিচয় করিয়ে দেওয়া। শিক্ষক অভিভাবক পড়ুয়াদের এমন মিলনমেলা খুব একটা দেখা যায় না।
ঠাসাঠাসি কর্মসূচি, এক জন গান গেয়ে স্কুলের মাঠে তৈরি করা বড় মঞ্চ থেকে নামে তো আর এক জন সেজেগুজে মঞ্চে হাজির তার নাচ নিয়ে, তৃতীয় জন তখন শেষ বার দেখে নিচ্ছে স্বরচিত কবিতার লাইনগুলি। স্কুলের অন্দরে বিশাল হলঘরে চলতে থাকে নাটক, বসে আঁকা, যেমন খুশি সাজা, কুইজ, পুতুলনাচের পুতুল বানানোর কর্মশালা। বড়দের নির্দেশ ছাড়া ইচ্ছে-ডানা মেলার অবাধ স্বাধীনতা। উৎসবের আনন্দ বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে ভেদাভেদহীন অংশগ্রহণ। মনে পড়েন রবীন্দ্রনাথ: “এই প্রেমের স্বাদ পাইবার জন্যই মানুষ উৎসবক্ষেত্রে সকল মানুষকে আহ্বান করে... সেদিন একলার গৃহ সকলের গৃহ হয়, একলার ধন সকলের জন্য ব্যয়িত হয়। সেদিন ধনী দরিদ্রকে সম্মানদান করে, সেদিন পণ্ডিত মূর্খকে আসনদান করে।”
ছেলেমেয়েদের জন্য পুরস্কার আছে বটে, কিন্তু সবার জন্য একই পুরস্কার, কোনও ভেদাভেদ নেই। একটি মানপত্র, একটি কলম। শিশুরা দারুণ খুশি, কারণ এ রকম ব্যবস্থা তারা কখনও দেখেনি, এত দিন দেখে এসেছে প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয়ের সঙ্গে বাকি সবাইকে বিচ্ছিন্ন করাই যেন প্রতিযোগিতার মূল উদ্দেশ্য। র্যাঙ্কিং-এর ব্যবস্থা শিশুদের ক্ষেত্রে যেমন বিপরীত প্রভাব ফেলতে পারে, শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও তেমনই। শিশুদের লেখাপড়ায় সব শিক্ষক সমান প্রয়াসী নন, সবাই সমান সুযোগ পান তেমনটাও না, তাই একের সঙ্গে আর একের তুলনা করাটাও ঠিক নয়। পাঁচ জন যদি পাহাড়ে ওঠে, এক জন সবার চেয়ে এগিয়ে থাকে, তাই বলে কি তার লক্ষ্য আলাদা? না অন্যদের কৃতিত্ব কম? কিন্তু ওঠার সময়ে চোখ থাকে উপর দিকে, নামার সময় থাকে নীচে, এর থেকেই বোঝা যায়, কে যাচ্ছেন উপরে, কে নামছেন নীচে। সে বিষয়ে শিক্ষকদের সচেতন থাকা উচিত।
দু’দিনের মেলায় শিশুরা মুক্তির স্বাদ পেল, শিক্ষকরাও পেলেন পড়ানোর গতানুগতিকতা থেকে মুক্তি। সবচেয়ে আনন্দ বোধহয় পেলেন মায়েরা; তাঁরা এখানে নিজস্ব একটা পরিসর পেলেন, পরস্পর এমন ভাবে মিশে গেলেন, যেন কত কালের চেনা। উৎসবের ভিতর দিয়ে একটা নতুন শিক্ষাচৈতন্যের সূচনা। সূচনা, অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের ভাষায়, ‘দায়িত্ববোধ’-এর শুধু জবাবদিহি নয়, তার চেয়েও একটা প্রসারিত ব্যাপার আছে, সেটা হল নিজস্ব ‘দায়িত্ববোধ’। স্বরূপনগরের মানুষরা সেটাই দেখালেন।
প্রতীচী ইনস্টিটিউটে কর্মরত