অর্থনীতির যুক্তি আবারও রাজনৈতিক রেষারেষির চোরাবালিতে পড়িয়াছে। জমি অধিগ্রহণ বিল লইয়া যে আলোড়ন ক্রমশ তীব্রতর হইয়া শেষ পর্যন্ত আইন সংশোধনের উদ্যোগটিকেই বানচাল করিতে প্রবৃত্ত, তাহা চরিত্রে রাজনৈতিক। প্রধানমন্ত্রী তাঁহার বেতারবাহিত ‘মনের কথা’য় এই বিলের বিরোধিতাকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলিয়া নিন্দা করিয়াছেন। কথাটি সত্য, কিন্তু অর্ধসত্য। জমি এবং কৃষক লইয়া রাজনীতি বিরোধীরা করিতেছে, সরকারও করিতেছে। ইউপিএ সরকারের কোন মন্ত্রী কবে সেই সরকারের প্রস্তাবিত জমি অধিগ্রহণ বিল সম্পর্কে আপত্তি জানাইয়া চিঠি লিখিয়াছিলেন, সেই চিঠি ফাঁস করিয়া বিরোধী দলকে সমস্যায় ফেলিবার তৎপরতা রাজনৈতিক কৌশল ভিন্ন কিছু নহে, তাহা নরেন্দ্র মোদী বিলক্ষণ জানেন। তিনি বা তাঁহার অর্থমন্ত্রী বলিতেই পারেন, রাজনীতিতে কৌশলের ভূমিকা স্বীকৃত এবং গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তাহা হইলে বিরোধীরাও কৌশল করিবেন, ইহাই স্বাভাবিক। রাজ্যসভায় সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাব কাজে লাগাইতে বিরোধীরা তৎপর হইবেন, ইহাই বা অস্বাভাবিক হইবে কেন?
বস্তুত, বিরোধীদের রাজনৈতিক ‘অপপ্রচার’-এর অভিযোগে অভিযুক্ত করিবার আগে প্রধানমন্ত্রী ভাবিয়া দেখিলে ভাল করিতেন, দায়টা তাঁহারই, কারণ তিনি সরকার চালাইতেছেন, বিরোধীরা নহে। জমি বিলের বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনৈতিক শিবির যে ভাবে কার্যত দলমতনির্বিশেষে সংগঠিত হইয়া উঠিয়াছে, তাহা কেবল এই বিল প্রণয়ন নয়, সামগ্রিক ভাবে সরকারের আর্থিক সংস্কারের নীতি রূপায়ণের পথেই বড় বাধা হইয়া উঠিতে পারে। কাজ করিবার প্রতিশ্রুতি দিয়া মোদী ক্ষমতায় আসিয়াছেন, এখন ‘বিরোধীরা বাধা দিল, তাই সংস্কার করিতে পারিলাম না’ বলিলে ইতিহাস তাঁহাকে ক্ষমা করিবে না, সম্ভবত ভোটদাতারাও বিরূপ হইবেন। সুতরাং তাঁহার কাজ জমি বিলটিকে সংসদীয় বৈতরণি পার করানোর জন্য সর্বতোভাবে যত্নবান হওয়া। প্রচারের লড়াইয়ে জয়রাম রমেশদের হারাইয়া নিজের পিঠ চাপড়ানো কোনও কাজের কথা নহে, এখন আর নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁহার সহযোগীরা নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রত নহেন, এখন তাঁহারাই শাসক। ক্ষুদ্র রাজনীতি হইতে অর্থনীতির যুক্তিকে উদ্ধার করিতে না পারিলে তাঁহাদের মর্যাদা বাড়িবে না।
অর্থনীতির যুক্তি স্পষ্ট। জমি অধিগ্রহণের আইনে যে ধরনের সংশোধন সরকার কার্যকর করিতে চাহিতেছে, তাহা লইয়া প্রশ্ন থাকিতে পারে, কিন্তু শিল্প বা পরিকাঠামোর জন্য জমি লইবার সুবন্দোবস্ত যে জরুরি তাহা লইয়া কোনও প্রশ্ন নাই। এই বিষয়ে যে সব বিবাদী সুর শোনা যাইতেছে, তাহা প্রধানত দুই প্রকার। বিরোধীদের একাংশ জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে সতর্কতা ও সুবিবেচনার পক্ষে সওয়াল করিতেছেন, বিশেষত সংশ্লিষ্ট কৃষকদের সম্মতি এবং জমি অধিগ্রহণের সামাজিক প্রতিক্রিয়াকে গুরুত্ব দানের কথা বলিতেছেন। এই বিষয়ে তাঁহাদের সঙ্গে আলোচনা ও বিতর্ক নিশ্চয়ই চলিতে পারে, গণতন্ত্রে চলা উচিতও। আর এক দল বিরোধী কার্যত স্থিতাবস্থা অবিকৃত রাখিতে চাহেন, তাঁহারা মুখে যাহাই বলুন, প্রকৃত প্রস্তাবে শিল্পায়ন বা উন্নয়ন চাহেন না। এই দুই ধরনের বিরোধিতার মোকাবিলা স্বতন্ত্র ভাবে করা দরকার। অচলায়তনের প্রবক্তাদের মনের কথা বাহির করিয়া আনিতে পারিলে এবং একই সঙ্গে ইতিবাচক সমালোচনা শ্রদ্ধার সহিত শুনিয়া প্রয়োজনীয় আত্মসংশোধনে ব্রতী হইলে সরকার দ্বিতীয় গোষ্ঠীকে বহুলাংশে সঙ্গে পাইবেন, প্রথম গোষ্ঠীকে বিচ্ছিন্ন করিতে পারিবেন। তাহা হইবে সচলায়তনের রাজনীতি। তাহা অর্থনীতির যুক্তির ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। উন্নয়নের অর্থনীতি।