সম্পাদকীয় ১

সত্তর খুন মাফ

আজ কলকাতা পুরসভার নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীর ভূমিকায় থাকিবে। কিন্তু, ইহাই সেই দলের একমাত্র পরিচয় নহে। তাহাদের বৃহত্তর পরিচয়, রাজ্যের শাসনক্ষমতা তাহাদের হাতে। প্রশ্ন হইল, সর্বাধিনায়িকা দলের কোন পরিচিতিটিকে প্রাধান্য দিতেছেন? পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন বহু পূর্বেই তাহার নিরপেক্ষতা আদি গঙ্গার জলে ভাসাইয়া দিয়াছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০২
Share:

আজ কলকাতা পুরসভার নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীর ভূমিকায় থাকিবে। কিন্তু, ইহাই সেই দলের একমাত্র পরিচয় নহে। তাহাদের বৃহত্তর পরিচয়, রাজ্যের শাসনক্ষমতা তাহাদের হাতে। প্রশ্ন হইল, সর্বাধিনায়িকা দলের কোন পরিচিতিটিকে প্রাধান্য দিতেছেন? পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন বহু পূর্বেই তাহার নিরপেক্ষতা আদি গঙ্গার জলে ভাসাইয়া দিয়াছে। শাসকের পদতলেই তাহার স্বর্গ। স্বতঃপ্রণোদিত হইয়া প্রশাসন নিরপেক্ষ ভাবে নির্বাচনী প্রক্রিয়া পরিচালনা করিবে, তেমন সম্ভাবনা এই রাজ্যে ছিল না। অতএব, মহানগরীর পুর-নির্বাচনে শান্তিরক্ষার প্রশ্নটি নির্ভরশীল ছিল শাসকদলের সদিচ্ছার উপর। মুখ্যমন্ত্রী নিজের প্রশাসক সত্তাকে অধিকতর গুরুত্ব দিলে তিনি পুলিশ-প্রশাসনকে সেই অভিমুখে পরিচালিত করিতেন। কলিকাতার নির্বাচনী হিংসার প্রাবল্য বলিতেছে, মুখ্যমন্ত্রী ক্ষুদ্র পরিচয়টিকেই ধ্রুব জ্ঞান করিয়াছেন। রাজ্য জুড়িয়াই বেধড়ক সন্ত্রাস চলিতেছে। পুলিশ যেখানে আক্রান্ত নহে, সেখানে তাহারা নিছক দর্শকের ভূমিকায়। বিরোধীদের মিছিলে হামলা, প্রচারে বাধা দেওয়া, প্রার্থী বা সমর্থকদের আক্রমণ করা— সন্ত্রাসের আঠারো কলা পূর্ণ হইয়াছে। এই অরাজকতার দায় সম্পূর্ণত রাজ্যের শাসক দলের। তাহাদের অভিধানে ‘রাজধর্ম’ নামক শব্দটির কোনও ঠাঁই নাই।

Advertisement

এই পরিস্থিতিটির জন্য মুখ্যমন্ত্রী দুই দফায় দায়ী। সেই দায়ের এক অংশ পরোক্ষ। তাঁহার প্রশাসন নিরপেক্ষতা বজায় রাখিতে ব্যর্থ। নির্বাচনী সন্ত্রাসে লাগাম পরাইবার ক্ষমতা প্রশাসনের হয় নাই। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে এই ব্যর্থতার দায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর বর্তায় বইকী। তবে, তৃণমূলের সর্বাধিনায়িকার প্রত্যক্ষ দায়ের তুলনায় এই পরোক্ষ দায়ের ভার কম। তিনি কখনও সরাসরি দুষ্কৃতীদের আড়াল করিয়াছেন, কখনও দলের অপরাধ ঢাকিতে অলীক যুক্তি খাড়া করিয়াছেন। রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেই যেমন। প্রকৃত প্রশাসকের কর্তব্য ছিল, তিনি এই ঘটনার নিন্দা করিবেন এবং দুষ্কৃতীদের দ্রুত গ্রেফতার করিবার নির্দেশ দিবেন। পরিবর্তে মুখ্যমন্ত্রী বিবিধ কুযুক্তি খাড়া করিতেছেন। উল্লেখ্য, এই ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত আলিপুর থানায় হামলারও মূল পাণ্ডা ছিলেন বলিয়া অভিযোগ। মুখ্যমন্ত্রীর স্নেহভাজন নেতার ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে তিনি এখনও অধরা। এই ঘটনাগুলির প্রেক্ষিতে মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়ায় বার্তা দ্ব্যর্থহীন— তাঁহার আশ্রয়ে থাকিলে সত্তর খুন মাফ। শুধু নির্বাচনকেন্দ্রিক সন্ত্রাসের ক্ষেত্রেই নহে, গত চার বৎসর যাবৎ মুখ্যমন্ত্রী ব্যতিক্রমহীন ভাবে এই বার্তাই দিয়া চলিতেছেন। বার্তাটি ব্যর্থ হয় নাই। আজকের অরাজকতা তাহারই ফল।

এক্ষণে একটি বৃহত্তর প্রশ্ন উত্থাপন করা প্রয়োজন। রাজনীতির পঙ্কিল গতি বলিতেছে, রাজ্যের প্রশাসনিক ক্ষমতার এই অপব্যবহার প্রায় অনিবার্য। অতএব প্রশ্ন, যে দলগুলি রাজ্যস্তরের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে, তাহাদের কেন পুর-স্তরে নির্বাচন লড়িতে দেওয়া হইবে? তৃণমূল কংগ্রেস নামক দলটি যদি পুরসভার নির্বাচনে অংশগ্রহণই না করিতে পারে, তবে এই নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নষ্ট করিবার প্রবল তাগিদও তাহাদের না থাকাই স্বাভাবিক। কথাটি অন্য দলগুলির ক্ষেত্রেও সমান ভাবে প্রযোজ্য। অন্য দিকে, বিধানসভা আর পুরসভার কাজ পৃথক। দ্বিতীয়টি মূলত পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা। সুতরাং, তাত্ত্বিক ভাবেও পুরসভায় মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলির উপস্থিতি অপ্রয়োজনীয়। পুর-স্তরের নির্বাচনটি মূলধারার দলগুলির নাগালের বাহিরে রাখাই বিধেয়। একেবারে পুর-পরিষেবাকেন্দ্রিক দলের জন্যই এই নির্বাচনের দরজা খোলা রাখা ভাল। নচেৎ, ২০১৫ সালের কুনাট্য দীর্ঘজীবী হইবে।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন