জাতিস্মর মুকুল ধরও শেষ অবধি তাহার বর্তমান জন্মকেই মানিয়া লইয়াছিল। অতীত, অতীতই। তাহার গৌরবও যেমন, অগৌরবও তেমনই— বর্তমানে কোনওটির বোঝাই বহিবার নহে। বিধানসভা নির্বাচনে জিতিয়া ফের সরকার গঠন করাকে পুনর্জন্ম বলা চলিতেই পারে। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তাঁহার দ্বিতীয় জন্মে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দৃশ্যত সতর্ক। গত দেড় মাসে তিনি যাহা বলিয়াছেন, এবং বলেন নাই, সেই কথাগুলির একটি সুনির্দিষ্ট অভিমুখ দৃশ্যমান। প্রত্যয় হয়, তিনি পূর্বজন্মের ভ্রান্তি ঝাড়িয়া ফেলিতে চাহেন, নূতন করিয়া শুরু করিতে চাহেন। তাঁহার কথাতেই যে কাজ হইতে পারে, উত্তরবঙ্গে তাহার সংকেত মিলিতেছে। আরও বড় পরীক্ষা দখলদারি ও সিন্ডিকেটের ক্ষেত্রে। মুখ্যমন্ত্রী কঠোর স্বরে বলিয়াছেন, উন্নয়নের পথে কোনও বাধাই তিনি সহ্য করিবেন না। কাজটি কঠিন, সন্দেহ নাই। কিন্তু, দলের নাম তৃণমূল কংগ্রেস বলিয়াই, অসম্ভব নহে। তাঁহার দলে তিনিই আইন, তাঁহার ইচ্ছাই চূড়ান্ত নির্দেশ। ফলে, তিনি যদি সত্যই নিজের কথায় অটল থাকিতে পারেন, রাজনীতির চোরাস্রোত যদি তাঁহার সদিচ্ছাকে টানিয়া লইয়া না যায়, তবে পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে ঘুরিয়া দাঁড়ানো হয়তো সত্যই সম্ভব। গোড়ায় অনেকেরই স্বার্থে ঘা লাগিবে— মৌচাকে ঢিল মারিলে হুলের জ্বালা সহ্য না করিয়া উপায় নাই। প্রশ্ন হইল, সুবিধাভোগীদের সম্মিলিত স্বার্থ বনাম মুখ্যমন্ত্রীর সদিচ্ছা, দড়ি টানাটানিতে কোন পক্ষের জয় হইবে?
সম্মিলিত (অপ)স্বার্থের জোর কম নহে। এবং, সেই জোরটি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরই দেওয়া। ইহাই পূর্বাশ্রমের ভাগশেষ। তাঁহার প্রথম পাঁচ বৎসরে সব অরাজকতাই প্রশ্রয় পাইয়াছে। তিনি সিন্ডিকেটের রমরমা দেখিয়াও দেখেন নাই; জমি না লইবার অযৌক্তিক জেদে জবরদখলকারীরাও প্রশ্রয় পাইয়াছে; রাজ্যের প্রতিটি প্রান্তে শাসক দলের মেজো-সেজো নেতারাও দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হইয়া বসিয়াছেন। তাহাতে দলের কতখানি লাভ হইয়াছিল, সে প্রশ্ন ভিন্ন— কিন্তু, রাজ্যের ক্ষতি হইয়াছিল বিস্তর। অনুমান করা চলে, দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসিয়া মুখ্যমন্ত্রী বুঝিতেছেন, গত পাঁচ বৎসর যে ভাবে চলিয়াছে, আগামী পাঁচ বৎসর চলিতে পারিবে না। কথাটি বুঝিতে বিলম্ব হইল। কিন্তু, এখনও সব শেষ হইয়া যায় নাই। মুখ্যমন্ত্রী যদি এখনও প্রকৃত চেষ্টা করেন, তবে ঘুরিয়া দাঁড়ানো সম্ভব। বিভিন্ন তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার দাবিদাওয়ার ক্ষেত্রে সরকার যে বাস্তববাদী নমনীয়তা দেখাইতেছে, তাহাও ভরসাজনক। ঘুঘুর বাসাগুলি সত্যই ভাঙিবে, না কি মুখ্যমন্ত্রীর সদিচ্ছা পদ্মপত্রে জল বলিয়া প্রতিপন্ন হইবে, তাহা দেখিবার।
সংশয় অহেতুক নহে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যােয়র সূচনা চির কালই লা-জবাব। ২০১১ সালে তাঁহার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে বিরোধী নেতাদের আপ্যায়ন এবং রাজনৈতিক সম্প্রীতির বার্তা, কর্মীদের সংযত থাকিতে বলা— সব মিলাইয়া বোধ হইতেছিল, পশ্চিমবঙ্গ হইতে ‘আমরা-উহারা’র সংস্কৃতি হয়তো বিদায় হইল। অনেকেই ভাবিয়াছিলেন, এই বিভাজনের রাজনীতির অন্ধকার দিকটি যেহেতু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেখিয়াছেন, তিনি স্বয়ং সে পথে হাঁটিবেন না। কিন্তু, তাহার পর কী হইল, জানে শ্যামলাল। জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক যখন সিপিআইএম সমর্থকদের সামাজিক বয়কট করিবার ডাক দিলেন, তাপস পাল যখন বিরোধীদের ঘরে ছেলে ঢুকাইয়া দেওয়ার হুমকি দিলেন, রাজ্যের এই প্রান্ত হইতে ওই প্রান্ত যখন সন্ত্রাসের কবলে চলিয়া গেল, মুখ্যমন্ত্রী রা কাড়েন নাই। তাঁহার সদিচ্ছার জোর ততখানি ছিল না। এই দফায় থাকিবে কি না, সময়ই বলিবে। তিনি পারিলে পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটি বাঁচিবে। এই দফার প্রথম দেড় মাসে তাহার কিছু লক্ষণ মিলিতেছে। সুলক্ষণ।