সম্পাদক সমীপেষু

ইতিহাসটা ঠিক করে জানা দরকার

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০১৫ ০০:০০
Share:

ফতপুর সিক্রি: সম্রাট আকবরের স্থাপত্যে হিন্দু-মুসলিম ঐতিহ্য-সমন্বয়।

ইতিহাসটা ঠিক করে জানা দরকার

Advertisement

তথাগত রায় তাঁর চিঠিতে (‘কেন সবাই ধর্ম বদলাননি’, সম্পাদক সমীপেষু, ১০-৩) উইল ও এরিয়েল ডুরান্ট-এর লেখা উদ্ধৃতি দিয়ে ইসলামের ভারতজয়ের নিষ্ঠুর ও কলঙ্কজনক কাহিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। ইতিহাসচর্চার সঙ্গে যুক্ত এক জন মানুষ হিসেবে বলি, উইল ডুরান্ট বড় মাপের পণ্ডিত হলেও (অনেক দিন আগে প্রয়াত) সিরিয়াস ইতিহাসবিদ হিসাবে গণ্য হন না। কোনও কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের পাঠ্যক্রমে কেউ তাঁর বই রেফার করেছেন বলেও শুনিনি। ভারতীয় ইতিহাস ও মধ্যযুগ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কোনও ইতিহাসবিদের কাছ থেকেই এ ব্যাপারে প্রামাণ্য জ্ঞানলাভ করা যেতে পারে।

তা ছাড়া, ইতিহাসচর্চার অগ্রগতি হয়, পুরনো জ্ঞান ও ধারণা বাতিল হয়ে যায়। সুতরাং সাম্প্রতিক গবেষণালব্ধ জ্ঞান ও সিদ্ধান্তের দ্বারস্থ হওয়াই আমাদের কাম্য। ইতিহাসবিদ মহলে বর্তমানে এটা স্বীকৃত সত্য যে দিল্লির মুসলিম শাসকেরা রাজনৈতিক উদ্যোগে গণধর্মান্তরকরণের কোনও কার্যক্রম গ্রহণ করেননি। তার মানে দিল্লির সুলতানরা খুব উদার ছিলেন তা নয়, কিন্তু তাঁরা মনে করেছিলেন ভারতের মতো দেশে এই ধরনের উদ্যোগ বাস্তবসম্মত হবে না। যুদ্ধের সময় বা ধনরত্নের লোভে মন্দির ধ্বংসের কিছু ঘটনা অবশ্যই ঘটেছে। সুলতান মামুদের লুণ্ঠনলিপ্সা সুবিদিত। কিন্তু এটাও স্মরণে রাখা আবশ্যক যে, তাঁর সেনাবাহিনীতে হিন্দু সদস্যও ছিলেন, এবং ইতিহাসে মুসলিম ও খ্রিস্টানদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য মামুুদের পেগান ভারতীয় সৈন্যদের অভিযুক্ত করা হয়েছে।

Advertisement

মহম্মদ বিন তুঘলক ছিলেন দিল্লির সুলতানদের মধ্যে সবচেয়ে উদার। তিনি জৈন পণ্ডিতদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, হোলি উত্‌সবে অংশ নিয়েছেন, নিম্নবণের্র্র্র কিছু হিন্দুকে অভিজাতমণ্ডলীর মধ্যে স্থান করে দিয়েছেন। অথচ তথাগতবাবুর চিঠিতে ডুরান্টদের উদ্ধৃতিতে তাঁর রাজসভার সামনে ‘হিন্দুদের মৃতদেহের পাহাড়’ জমে থাকার কথা বলা হয়েছে। খুব বিভ্রান্তিকর বক্তব্য। আসলে মহম্মদ বিন তুঘলকের শাসনকালে দিল্লিতে সাত বছর স্থায়ী ভয়ঙ্কর এক দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। যাতে বহু মানুষ মারা যান। সুতরাং ‘মৃতদেহের পাহাড়’ মানেই ধর্মীয় গণহত্যা নয়। খেয়াল রাখা দরকার, তত্‌কালীন মুসলমান লেখকদের রচনায় ভারতকে বলা হত ‘হিন্দ’ আর ভারতীয় বা দেশজ মানুষকে হিন্দু। তাই ‘হিন্দু’ শব্দটির উল্লেখ মানেই তা ধর্মীয় ব্যঞ্জনা পেয়ে যায় না। মধ্যযুগে রাজনৈতিক বা সামরিক হত্যাকাণ্ডের বহু নিদর্শন ইতিহাসে আছে। কিন্তু ব্যাপক কোনও ধর্মীয় সামাজিক সংঘর্ষ ও হত্যাকাণ্ডের নজির ভারত-ইতিহাসে নেই।

তথাগতবাবুর চিঠিতে জিজিয়া ও ব্রাহ্মণ হত্যার কথা এসেছে। তাই এ ব্যাপারে একটি ‘চমকপ্রদ’ তথ্য উল্লেখ না-করে পারছি না। সুলতানি যুগে ব্রাহ্মণরা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা না পেলেও তাঁরা ছিলেন সুবিধাভোগী শ্রেণি। যেমন, তাঁদের জিজিয়া কর দিতে হত না। (যেমন দিত না নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী সৈনিকরা)। ফিরুজ তুঘলক ছিলেন গোঁড়া। তিনি ব্রাহ্মণদেরও জিজিয়ার আওতায় নিয়ে আসেন। সামস ই সিরাজ আফিফের লেখা তারিখ-ই-ফিরুজশাহি-তে উল্লেখ আছে। এর প্রতিবাদে দিল্লির ব্রাহ্মণরা আন্দোলনে নামেন এবং আত্মাহুতির হুমকি দেন। ফিরুজ তাতেও পিছপা না হলে নিম্নতর বর্ণের হিন্দুরা ব্রাহ্মণদের হয়ে জিজিয়া কর প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ব্রাহ্মণরা এতে খুশি হয়ে আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন। ফিরুজও তখন জিজিয়ার হার কিছুটা কমিয়ে দেন।

‘হিন্দুধর্ম বা হিন্দু আচারকে বেআইনি করতে গিয়ে মুসলিম শাসকরা হিন্দুদের হৃদয়ে ধর্মকে আরও গভীর ভাবে প্রোথিত করে দিয়েছিল’— ডুরান্টদের এই বক্তব্য একেবারেই প্রামাণিক নয়। মুসলিম শাসকরা যেমন হিন্দুর ধর্মীয় আচার নিষিদ্ধ করেননি, তেমনই এ যুগের সাধারণ হিন্দু জনগণ ইসলামের প্রতিক্রিয়ায় আরও বেশি করে ধর্মনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল, এর কোনও প্রমাণ নেই। মধ্যযুগীয় ভারতীয় সমাজ যুযুধান দুটি ধর্মীয় শিবিরে ভাগ হয়ে গিয়েছিল এবং ইসলামের ‘আগ্রাসন’-এর বিরুদ্ধে হিন্দু জনগণ মরণপণ প্রতিরোধ চালিয়ে গিয়েছিল— এ রকম কোনও ছকে মধ্যযুগের ইতিহাস পাঠ করা যায় না।

আমরা কখনওই বলছি না, মধ্যযুগীয় সমাজ ছিল ধর্মীয় সহাবস্থান, মিলন ও সমন্বয়ের এক ‘স্বর্গরাজ্য’—অসহিষ্ণুতা, ভেদাভেদ ও গোঁড়ামির প্রকট উপস্থিতি রীতিমত ছিল, কিন্তু সেই সঙ্গে ছিল আদানপ্রদান ও মেলামেশার একটি ধারাও। এক ইতিহাসবিদের ভাষায় বলি, সমকালীন ইউরোপে অখ্রিস্টান ও খ্রিস্টীয় বিরুদ্ধবাদী গোষ্ঠী যেটুকু ধর্মাধিকার ভোগ করত, তার চেয়ে অনেক বেশি স্বাধীনতা বিরাজ করত ভারতে, মুসলিম শাসকদের সময়ে।

ধর্মান্তরকরণ ও ইসলামের প্রসার প্রসঙ্গে বলা যায়, এ ব্যাপারে আমাদের মধ্যে অনুমানভিত্তিক অনেক কথা চালু আছে। মনগড়া নানা ব্যাখ্যা অনেককে দিতে দেখি। কিন্তু এটা প্রমাণিত সত্য, এ দেশে ইসলামের প্রসার শাসকের তরবারির জোরে হয়নি। ইসলামের প্রসার ঘটেছে প্রধানত নিঃশব্দে, শান্তিপূর্ণ ভাবে, আর এ ব্যাপারে সুফিসন্তদের একটা বিরাট ভূমিকা আছে। ধর্মান্তরিত মুসলমানদের একটা বড় অংশ তথাকথিত নিম্নবর্ণ থেকেই এসেছিলেন সত্যি (তাঁরাই তো বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ), কিন্তু ব্রাহ্মণ্য বর্ণব্যবস্থার অত্যাচার থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষাই তাঁদের ইসলামে আশ্রয় নেওয়ার কারণ— এই বক্তব্য নিয়ে ইতিহাসবিদ মহলে সংশয় আছে। উত্‌সাহী পাঠক এ ব্যাপারে R M Eaton-এর The Rise of Islam and the Bengal Frontier (OUP) বইটি পড়ে দেখতে পারেন।

ইতিহাসের তথ্য ইতিহাসবিদদের কাছ থেকে জানা জরুরি। এ ব্যাপারে ইতিহাসবিদদেরও দায় থাকে— রুদ্ধ সেমিনার রুম বা শ্রেণিকক্ষের বাইরে বিপুলসংখ্যক জিজ্ঞাসু মানুষের কাছে সাম্প্রতিক গবেষণালব্ধ জ্ঞান পৌঁছে দেওয়ার দায়।

রাজকুমার চক্রবর্তী। শিক্ষক, ইতিহাস বিভাগ, বারাসত সরকারি কলেজ

শনিবার ছুটি কেন

আমাদের দেশ অনেক কিছুতে আছে। প্রচুর কাজ বাকি। আদালতে মামলার পাহাড়। ছুটিছাটা লেগেই আছে। আমার অনুরোধ, শনিবার দিনটিকে পূর্ণ কাজের দিন হিসেবে ঘোষণা করা হোক। স্কুলকলেজে শনিবার ছুটি থাকতে পারে, অফিসে বা আদালতে বছরে ৫২টা দিন নষ্ট করা হবে কেন?

দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। কলকাতা-৮৯

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন