সম্পাদক সমীপেষু

পুলিশি রিপোর্টের বাইরে যে সত্য

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৪ ০১:১৩
Share:

ভাঙচুরের পরে। কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরি, প্রেসিডেন্সি কলেজ। ১৯৬৬

পুলিশি রিপোর্টের বাইরে যে সত্য

Advertisement

ছাত্র আন্দোলন সংক্রান্ত আলোচনায় প্রেসিডেন্সি কলেজ ছাত্র আন্দোলন বিষয়ে আমি যে কথাগুলি বলেছি (‘শিক্ষায়তনে গণতন্ত্র...’, ২২-১০), সে বিষয়ে প্রাক্তন পুলিশকর্তা নিরুপম সোম একটি চিঠি লিখেছেন (‘প্রেসিডেন্সি কলেজে...’, ৫-১১)। কিন্তু লালবাজারের ঘেরাটোপে সরকারি বয়ান আর অধস্তনদের রিপোর্ট সম্বল করে ‘সত্য’ উন্মোচনের দায় নিলে খুব মুশকিল হয়। কয়েকটি কথা জানাতে চাই।

এক, নিরুপমবাবু দাবি করেছেন যে, অমল সান্যাল প্রেসিডেন্সি কলেজ ইউনিয়নের সম্পাদক ছিলেন না। কিন্তু কে ছিলেন, তা নিয়ে কিছু বলেননি। আমাদের জানা মতে, ১৯৬৫ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ ছাত্র ফেডারেশন বেশ ক’বছর পর কলেজ নির্বাচনে বিজয়ী হয় এবং অমল সান্যাল ইউনিয়ন সম্পাদক নির্বাচিত হন।

Advertisement

দুই, নিরুপমবাবু লিখেছেন ‘প্রেসিডেন্সি কলেজে ইউনিয়ন ওই সময়ে পিসিএসও বা এসএফআইয়ের দখলে থাকত’। তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া যেতে পারে যে, এসএফআই সংগঠনের তখন জন্মই হয়নি। কলেজে ছিল পিসিএস ও এবং পিসিএসএফ: প্রেসিডেন্সি কলেজ ছাত্র ফেডারেশন।

তিন, নিরুপমবাবু পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কথা লিখেছেন। ঘটনা হল, বুদ্ধদেববাবু কলেজ জীবনে কোনও কোনও ভাবেই ছাত্র সংগঠন বা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তিনি নাকি ‘বার বার বলেছেন, ওই ঘেরাওয়ের সঙ্গে এসএফআইয়ের কোনও বারই কোনও যোগ ছিল না’। আবার বলছি, ওই সময়ে এসএফআই ছিল না, তখন ছিল বিপিএসএফ (বাম) বা বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশন (বাম)। বুদ্ধবাবুর বকলমে নিরুপমবাবুর বক্তব্য হল, প্রেসিডেন্সি আন্দোলনের সঙ্গে বিপিএসএফ (বাম)-এর কোনও যোগ ছিল না। তা-ই যদি হয়, তা হলে সেখানে বিমানবাবু কেন? নিরুপমবাবু নিজেই তো বিমান বসুর কথা লিখেছেন। স্মরণ করা যেতে পারে যে, বিমান বসু ছিলেন বিপিএসএফ (বাম) সংগঠনের অন্যতম প্রধান নেতা।

চার, এর পর নিরুপমবাবু সে দিনের ঘটনার এক নাটকীয় বিবরণ দিয়েছেন। তত্‌কালীন মুখ্যমন্ত্রীর কী নির্দেশ ছিল তা আমার জানা নেই, কিন্তু সেদিন পুলিশের যে রণং দেহি মূর্তি দেখেছি, তা নিরুপমবাবুর বক্তব্যের সঙ্গে মেলে না। সন্ধে থেকে কলেজের চার পাশে পুলিশ জড়ো হচ্ছিল। রাত বাড়তেই বুঝে গেলাম, পুলিশি হামলা আসন্ন। দ্রুত দু’টি সিদ্ধান্ত নেওয়া হল: এক, বিনা প্রতিরোধে পুলিশকে কলেজে ঢুকতে দেওয়া হবে না। কলেজ গেটে সেই প্রতীকী প্রতিরোধ করবেন অমল সান্যাল ও বিমান বসু। দুই, সবাই গ্রেফতার হলে চলবে না। পর দিন থেকেই আন্দোলন অব্যাহত রাখার জন্য তিন জন (আমি, সব্যসাচী চক্রবর্তী ও অশোক সেনগুপ্ত) পুলিশি ঘেরাওয়ের বাইরে চলে যাবে। সেই মতো আমরা চলে গেলাম। কলেজ ঘিরে তখন প্রচুর পুলিশ। চার পাশে অজস্র লোকজন। আমরা পরিচিত দোকান থেকে চাদর নিয়ে, সেই ভিড়ের মধ্যে চাদর মুড়ি দিয়ে দাঁড়িয়ে চোখের সামনে পুলিশি লাঠির ঘায়ে বিমান বসু ও অমল সান্যালকে লুটিয়ে পড়তে দেখলাম। নিরুপমবাবু পুলিশ রিপোর্ট মোতাবেক যা-ই বলুন, এই দৃশ্য ভুলবার নয়।

পাঁচ, নিরুপমবাবু লিখেছেন, ‘কোনও ছাত্রকে মারতে বা ধরতে হয়নি। ৩৯ জন ছাত্র গ্রেফতার হন ও সাত দিন পরে জামিন পান—এ কথাগুলি ঠিক নয়।’ ৪ অক্টোবর, ‘ঘেরাও মুক্তি’র দিন ৩৯ জন ছাত্রকে গ্রেফতার করে লালবাজারে রাখা হয়। আমি গ্রেফতার হই ১৬ অক্টোবর। জোড়াসাঁকো গারদ থেকে যেদিন সন্ধেবেলায় আমায় লালবাজারে চালান করা হয়, কিছু ছেলের তখন জামিন হয়ে গেছে, বাকিরা আমায় দেখে হইহই করে ওঠে। কিন্তু একটু পরেই তারা সকলে, শেষ ব্যাচ, জামিন পায়। যাওয়ার আগে তারা মজা করে আমায় ৩৯ জনের কম্বল দিয়ে যায়। সেই কম্বলের পাহাড়ের মধ্যে লালবাজার লক-আপে বসে আছি একা—এই ছবি আজও চোখে ভাসে, অথচ নিরুপমবাবুর দাবি, আমরা কেউই গ্রেফতারই হইনি!

ছয়, অমল সান্যালের কব্জি ভাঙা বা বিমান বসুর মালাইচাকি ‘নড়ে’ যাওয়ার ঘটনা নিরুপমবাবু অস্বীকার করেছেন। তা হলে অমল সান্যাল কি শখ করে প্লাস্টার নিয়ে ঘুরেছিলেন? বিমান বসুর মালাইচাকি ভেঙেছিল না ‘নড়ে’ছিল, আমার জানা নেই, তবে পুলিশি লাঠিতে আহত বিমানদাকে দীর্ঘদিন লেংচে লেংচে কোর্টে হাজিরা দিতে দেখেছি। নিরুপমবাবুর যুক্তি, পরবর্তী কালে বিমানদা এই ঘটনা নিয়ে তাঁকে কিছু বলেননি। তাতে কী প্রমাণ হয়? সে তো আমিও পরবর্তী কালে তাঁর সেই রাতের রুদ্রমূর্তি নিয়ে তাঁকে কিছু বলিনি। তাতে ঘটনাগুলো ‘না’ হয়ে যায় না।

সাত, নিরুপমবাবু কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরিতে ভাঙচুরের প্রসঙ্গ তুলেছেন। নিঃসন্দেহে এই কাজ নিন্দনীয়। কিন্তু কথা হল, আগের দিনই পুলিশি তাণ্ডবে নিগৃহীত ছাত্ররা এই অপকর্মে প্ররোচিত হয়। মনে আছে, ফিজিক্স ল্যাবরেটরির দিকে ধাবমান রোষে অন্ধ ছাত্রদের আমরাই থামাই। কিন্তু এই সুযোগে ছাত্র পেটানোর সাফাই হিসেবে ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে বলাটা ঠিক নয়। ঘটনা হল, ল্যাবরেটরিতে কিছু বোতল ভাঙা ছাড়া বিরাট কিছু ক্ষতি হয়নি। এটা যত ডেমনস্ট্রেটিভ ছিল, ক্ষতির পরিমাণ তেমন ছিল না। আর, শুধু কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরি কেন, সমগ্র কলেজটিই তো আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতো জ্ঞানতাপসদের স্মৃতিধন্য। সেই নিয়ে সত্যই কোনও আবেগ থাকলে নিরুপমবাবুর পুলিশ এই তীর্থক্ষেত্রে ছাত্র পেটাত না।

আট, নিরুপমবাবুর সর্বশেষ দাবি: ‘প্রেসিডেন্সির গেটের সামনে কেউ মাসের পর মাস মাদুর পেতে বসে আছে, এ কথাটিও সত্য নয়।’ আমার জানতে ইচ্ছে করে যে, মাসের পর মাস প্রেসিডেন্সি কলেজ যে বন্ধ ছিল, তা কি আমাদের তত্‌কালীন ডিসি সাহেবের জানা ছিল? কলেজ খুলে রাখার কোনও পুলিশি উদ্যোগ নিয়েছিলেন কি? উনি যা-ই বলুন, মাসের পর মাস আমরা কলেজ গেটেই বসে ছিলাম। ব্যারিস্টার মণি গুপ্তের মেয়ে পিনজু (সুদীপ্তা গুপ্ত) নিয়ম করে সকাল ১০টা থেকে ৫টা পর্যন্ত সমানে কলেজ গেটে বসে থাকতùসাদা শাড়িতে মূর্তির মতো বসে থাকা পিন্জুর সেই চেহারা আজও চোখে ভাসে। আমাদের সঙ্গে সংহতি জানাতে ওই গেটেই হাজির হয়েছিল শ্রমিক মিছিল, এসেছিল উত্‌পল দত্ত, জোছন দস্তিদার সহ শিল্পীদের মিছিল। সে সব ডিসি সাহেবের চোখে পড়েছিল কি?

তবে আমার এত কথা বলা সাজে না। সেই সময়ের কুশীলবদের অনেকেই এখনও রয়েছেন। সেই বিমান বসু, শ্যামল চক্রবর্তী, রণবীর সমাদ্দার, সুব্রত সেনগুপ্ত, অরুণ ভট্টাচার্য, প্রদ্যোত বন্দ্যোপাধ্যায়, রতন খাসনবিশ, দীপাঞ্জন রায়চৌধুরী, সুদর্শন রায়চৌধুরী, অচিন্ত্য গুপ্ত, বিপ্লব হালিম, কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়রা কলম ধরলেই সত্য উন্মোচিত হবে।

অসীম চট্টোপাধ্যায়। কলকাতা ১০২

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন