শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, মা সারদাদেবী, স্বামী বিবেকানন্দ
আমরা তো সমন্বয়ের কথাই শুনে এসেছি
‘কোনও হিন্দু বোরখা পরে নামাজ পড়তে পারে না, আর কোনও মুসলমান দুর্গাপুজোয় অঞ্জলি দিতে পারে না’ (৩০-১১) বিজেপি-র সমাবেশে রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের বক্তব্য প্রসঙ্গে কিছু কথা। প্রথমেই আসি দুর্গাপুজোর কথা নিয়ে। আমাদের দুর্গাপুজো এক মহা সমন্বয়ের মহোত্সব। সর্বপ্রকারের সর্বশ্রেণির লোক মাতৃসেবায় অগ্রসর। এখানে জাতি বর্ণ ধর্মের কোনও বাছবিচার থাকে না। রঘুনন্দন তাঁর ‘তিথিতত্ত্ব’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘এবং নানা ম্লেচ্ছগণৈঃ পূজ্যন্তে সর্বদস্যুভিঃ’। দুর্গাপ্রতিমার রূপদানে কেশ, জরির বস্ত্র ও বিভিন্ন অঙ্গসজ্জায় ব্যাপৃত থাকেন যে কারিগরেরা তাঁরা অধিকাংশই জাতিতে মুসলমান। কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন: আয় অশুচি আয়রে পতিত এ বার মায়ের পূজা হবে/ যেথা সকল জাতির সকল মানুষ নির্ভয়ে মার চরণ ছোঁবে।
১৮৯৮ সালের অগস্ট মাসে স্বামী বিবেকানন্দ অমরনাথ থেকে ফেরার পথে এসেছেন কাশ্মীরের ক্ষীরভবানীতে। সঙ্গে আছেন ভগিনী নিবেদিতা। এখানে আসামাত্রই স্বামীজির মধ্যে লক্ষ করা যায় এক অদ্ভুত ভাবান্তর। তখন যে দিকেই তিনি দৃষ্টি দিতেন দেখতেন জগন্মাতা দুর্গার উপস্থিতি। স্বামীজির চোখে পড়ল ছ’বছরের এক শিশুকন্যা পাশের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। পরিচয় করে তিনি জানলেন মেয়েটি এক মাঝির কন্যা। জাতিতে মুসলমান। স্বামীজি তাকে ডেকে এনে কাছে বসালেন। নিবেদিতাকে নির্দেশ দিলেন পূজার যাবতীয় আয়োজন সম্পূর্ণ করতে। শিশুকন্যাটিকে ‘উমা’ রূপে পূজা করলেন তিনি। নিবেদিতাকে বললেন, ‘যে দিকে ফিরছি কেবল দেখছি মাতৃমূর্তি’।
কথিত আছে, সম্রাট আকবরের পত্নী জোধাবাই নিয়মিত দুর্গাপুজো করতেন। শ্রীচৈতন্যদেবের ভক্ত যবন হরিদাস দৈনিক তিন লক্ষ নাম জপ করে ‘নামাচার্য’ রূপে অভিহিত হয়েছিলেন। মহাপ্রভু হরিদাসের মরদেহ নিজহস্তে সমাধি দিয়ে এক অভিনব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।
দবির খাস ও সাকর মল্লিক ছিলেন বাংলার নবাবের একজন প্রধান অমাত্য আর একজন সচিব। শ্রীচৈতন্য সংস্পর্শে এঁরা রূপ সনাতন হিসেবে পরিচিত হয়ে বৃন্দাবনের ষড় গোস্বামীর অংশ রূপে খাতিলাভ করেছিলেন।
‘যত মত তত পথ’ এই বাণীমন্ত্রেই আছে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের জীবনবেদ। ঠাকুরের ঐক্য ও সমন্বয়ের বাণী ছিল সর্বমতের, সর্বভাবের, সর্বসম্প্রদায়ের ও সর্বচিন্তাধারার। সমস্ত শাস্ত্রকে নিজের শাস্ত্রের ন্যায় বিশ্বাস, সর্বধর্মের ভগবানকে নিজের দেবতা রূপে পুজো করা শ্রীরামকৃষ্ণের লোকোত্তর জীবনে বিবিধ বৈচিত্রের আত্মপ্রকাশ। সমন্বয়াচার্য শ্রীরামকৃষ্ণ তাই প্রায়ই যেতেন মোল্লাপাড়া আর গেঁড়েতলার মসজিদে। এই একত্বের সাধনমন্ত্রে তিনি উদ্দীপ্ত হয়েছিলেন ইসলাম ধর্মের সাধনায়। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান নানা পথ দিয়ে এক জায়গায়ই যাচ্ছে। নিজের নিজের ভাব রক্ষা করে আন্তরিক তাঁকে ডাকলে ভগবান লাভ হবে। এ কথা বোলো না— আমারই পথ সত্য, আর সব মিথ্যা, ভুল। সব পথই সত্য, যত মত তত পথ’।
মা সারদাদেবীর জীবনবৈচিত্রে ধরা দিয়েছে এমন সব ঘটনা যা মানেনি জাতি ও গোত্রের কোনও রকম বন্ধন। তুঁতে চাষি আমজাদ সবার কাছে কুখ্যাত ডাকাত হিসেবে পরিচিত, মা তাকে ডেকে নিয়ে নিজের ঘরের বারান্দায় খেতে বসিয়েছিলেন। খাওয়ার পর মা নিজেই দরিদ্র মুসলমান ছেলেটির উচ্ছিষ্ট স্থান জল ঢেলে ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করলেন। তাঁকে এই কাজ করতে দেখে ভাইঝি নলিনী হাঁ হাঁ করে আতঙ্কে বলে উঠেছিলেন, ‘এ কী পিসিমা, ছত্রিশ জাতের এঁটো কুড়োচ্ছ! ও যে মুসলমান! জাত ধমর্র্ সব চলে যাবে যে!’ স্নেহময়ী মা তখন মৃদু হেসে বলেছিলেন, শরত্ আর নরেনের মতো আমজাদও তাঁর ছেলে। মায়ের কাছে ছেলের কোনও জাত নেই।
কাজী নজরুলের নিত্যদিনের প্রার্থনায় মহাবিদ্যা মহামায়া আদ্যাশক্তি দেবী কালিকা ওতপ্রোত বিরাজমান। কবি তাই বার বার ছুটে যেতেন দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণী মন্দিরে। কখনও বা কালীঘাটের কালী মন্দিরে। গলায় তাঁর রুদ্রাক্ষের মালা। কপালে সিঁদুরের তিলক। মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী মায়ের চরণতলে বসে শোনাতেন তাঁরই রচিত সব শ্যামা সংগীত। যখন তিনি হরি ঘোষ স্ট্রিটে থাকতেন সে সময় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কালীমূর্তির নয়নাভিরাম বিগ্রহ। রোজই জগন্মাতার আরাধনার জন্য আনতেন দু’হাত ভর্তি রক্তজবা। দেবীকে সাজিয়ে শুরু হত নজরুলের মাতৃপূজা। উদাত্ত কণ্ঠে গাইতেন তাঁর রচিত সব মাতৃসংগীত। সেই সময় তাঁর ‘বল রে জবা বল’ গানটি আকাশ বাতাস মুখরিত করেছিল।
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান সাহেবের সরস্বতীবন্দনা ভুবনবিদিত। ১৯৩৩ সালে আমেরিকার শিকাগোতে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় বিশ্ব ধর্ম মহাসম্মেলনে প্রখ্যাত মনস্বী সন্ন্যাসী ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারী ইসলামের এক নতুন সংজ্ঞা দিয়ে সমবেত শত শত প্রতিনিধির অভিনন্দন পেয়েছিলেন ISLAM: I Shall Love All Mankind.
ঈশ্বরের কাছে জাতি, কুল, সম্প্রদায় সবই নিরর্থক। গুণ ও কর্মই সেখানে প্রধান। এটাই ভারতধর্ম।
চৈতন্যময় নন্দ। মুগবেড়িয়া, পূর্ব মেদিনীপুর
বকেয়া ভাতা
ভানুপ্রকাশ ভৌমিকের বক্তব্য (‘বকেয়া ডিএ’, সম্পাদক সমীপেষু, ৬-১১) বর্তমান প্রেক্ষিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মূল বেতনের প্রায় অর্ধেক অর্থাত্ ৪৯ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা যে রাজ্য সরকারি কর্মচারীরা কম পাচ্ছেন, সে বিষয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের কোনও ভ্রুক্ষেপ আছে বলে মনে হয় না। এই মাগ্গিগণ্ডার বাজারে কর্মীদের, বিশেষত পেনশনভোগীদের যে কী হাল, তা একমাত্র তাঁরাই বুঝতে পারছেন। কিন্তু সরকার অবুঝ।
রাজ্য সরকার বলছে, মহার্ঘ ভাতা পুরো মেটানোর টাকা নেই। অথচ অহেতুক প্রচুর টাকা সরকারি কোষাগার থেকে খরচ করা হচ্ছে। বিভিন্ন মামলায় সুপ্রিম কোর্টে অযথা আপিল করে কোটি কোটি টাকা অপব্যয় করা হচ্ছে। এ ছাড়া, চলচ্চিত্র ও অন্যান্য উত্সবের জন্য এবং অন্যান্য অজস্র ক্ষেত্রে দানখয়রাতির বন্যা বয়ে যাচ্ছে। তাই জানতে চাই, এ সব হচ্ছেটা কী?
আমার মনে হয়, আর কালবিলম্ব না-করে নানা কর্মচারী সংগঠনের (কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত) সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে বঞ্চনা ও খামখেয়ালিপনার অভিযোগে হাইকোর্টে মামলা রুজু করা দরকার। কিছু একটা বিহিত হয়তো হলেও হতে পারে। এ ছাড়া বিকল্প নেই।
সন্তোষ চক্রবর্তী। কলকাতা-৩৪