সম্পাদকীয় ২

সম্মান, না লজ্জা

পরিবারের ‘সম্মানরক্ষা’য় আরও একটি কন্যানিধনের অভিযোগ। ঘটনাস্থল খাপ পঞ্চায়েতের কর্তৃত্বাধীন হরিয়ানা কিংবা পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের কোনও প্রান্তীয় গ্রামীণ জনপদ নয়, খাস দিল্লি। পাত্রপাত্রীরাও রাজধানী দিল্লিরই বাসিন্দা। ২১ বছর বয়স্ক ভাবনা দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। আর যাঁহার প্রেমে পড়িয়া তাঁহাকে বিবাহ করার অপরাধে তিনি নিজের বাবা-মা ও মামার হাতে নিহত বলিয়া অভিযোগ, সেই পাত্র অভিষেক রাষ্ট্রপতি-ভবনে কর্মরত। ভাবনার পরিবার ‘শিক্ষিত’, মধ্যবিত্ত।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০৪
Share:

পরিবারের ‘সম্মানরক্ষা’য় আরও একটি কন্যানিধনের অভিযোগ। ঘটনাস্থল খাপ পঞ্চায়েতের কর্তৃত্বাধীন হরিয়ানা কিংবা পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের কোনও প্রান্তীয় গ্রামীণ জনপদ নয়, খাস দিল্লি। পাত্রপাত্রীরাও রাজধানী দিল্লিরই বাসিন্দা। ২১ বছর বয়স্ক ভাবনা দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। আর যাঁহার প্রেমে পড়িয়া তাঁহাকে বিবাহ করার অপরাধে তিনি নিজের বাবা-মা ও মামার হাতে নিহত বলিয়া অভিযোগ, সেই পাত্র অভিষেক রাষ্ট্রপতি-ভবনে কর্মরত। ভাবনার পরিবার ‘শিক্ষিত’, মধ্যবিত্ত। কন্যাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাইতে তাঁহারা দ্বিধা করেন নাই। কিন্তু সেই শিক্ষা তাঁহাদের কন্যার মনের অন্ধকার ঘুচাইয়া দিবে, তাহাকে ভেদভাবজনিত তামসিকতা হইতে মুক্ত করিবে, ইহা স্পষ্টতই তাঁহাদের অভিপ্রেত ছিল না। লেখাপড়া শিখিলে বিবাহের বাজারে কন্যার দর বাড়িবে, ইহাই বোধ করি তাঁহাদের বাসনা ছিল। কিন্তু ভাবনা বাবা-মা’র সেই অভিপ্রায় পূরণ করার পরিবর্তে নিজেই জীবনসঙ্গী মনোনীত করিলেন ও জাত-গোত্রের বিবেচনা উপেক্ষা করিয়া প্রেমজ বিবাহে বাঁধা পড়িলেন। এ ‘অপরাধ’ বাবা-মা কেমন করিয়া ক্ষমা করিবেন?

Advertisement

ভাবনার মতোই ২৬ বছরের আর এক তরুণী ছিলেন প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষয়িত্রী। ভিন্ জাতের ইঞ্জিনিয়ার ছেলের প্রেমে পড়িয়া বিবাহ করিতে চাহিলে তাঁহার মা, ভাইয়েরা এবং কাকা গলা টিপিয়া তাঁহাকে হত্যা করে এই দিল্লিতেই। এক মহিলা সাংবাদিকের কথাও অনেকের মনে থাকিবে, যাঁহার ব্যাঙ্ক-অফিসার বাবা এবং ডক্টরেট পাওয়া ভাই-দাদারা অন্য যুবকের সহিত জাতের ছেলের সঙ্গে বিবাহ মানিয়া লইতে পারেন নাই। নিগ্রহ-গঞ্জনায় বীতশ্রদ্ধ মেয়েটি আত্মঘাতী বা নিহত হন। দৃশ্যত, প্রতিটি ক্ষেত্রেই পরিবারের ‘সম্মান’ ধ্বংস হওয়ার অপযুক্তি ঘাতকদের প্ররোচিত করিয়াছে আর সেই সম্মানকে জড়াইয়া দেওয়া হইয়াছে জাত-গোত্রের সহিত। অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীর সমাজমানস একবিংশ শতাব্দীর নাগরিক ভারতের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারগুলিতে সযত্নে লালিত হইয়া চলিয়াছে। ইতিমধ্যে মহিলাদের সমানাধিকার ও ক্ষমতায়নের সমর্থনে আন্দোলন ও প্রচার রকমারি আইনকানুন প্রণয়নে সহায়ক হইয়াছে। সম্পত্তির উত্তরাধিকার হইতে শুরু করিয়া বিবাহ-বিচ্ছেদ-উত্তর সন্তানের অভিভাবকত্বের অধিকার, মায়ের পরিচিতিতে মাথা উঁচু করিয়া চলিবার আইনি অনুমোদন, ইত্যাদি। কিন্তু সমাজ কি এতটুকু পাল্টাইয়াছে?

মানুষে-মানুষে কৃত্রিম বিভেদ সৃষ্টিকারী সামাজিক কুপ্রথা ও বন্দোবস্তগুলিকে সম্মার্জনীযোগে বিদায় করার পরিবর্তে সনাতন ভারতের কদর্য ও ঘৃণ্য আচারগুলিকে আঁকড়াইয়া থাকার মধ্যযুগীয় মানসিকতা আজও বহাল। শিক্ষা, আধুনিকতা, পাশ্চাত্যের প্রাগ্রসর চেতনার অভিঘাত— কোনও কিছুই তাহাকে টলাইতে পারে নাই। তাই পরিবারের সম্মান এখনও স্বজাতে বিবাহ করার মধ্যে নিহিত। অন্য জাতে, বিশেষত অপেক্ষাকৃত নিম্ন জাতে বিবাহ করিলে সমাজের নিকট নাকি পরিবারের মাথা কাটা যায়। ভারতীয় সমাজ দীর্ঘকাল যাবৎ পারিবারিক সম্মান বা মর্যাদার এমন লজ্জাকর সংজ্ঞা অনুশীলন করিয়া আসিয়াছে। রাজধানীও যে খাপ-এর প্রান্তীয় অন্ধকারে পড়িয়া আছে, তাহার ধিক্কারযোগ্য প্রমাণ কম নাই। শিক্ষা বা আধুনিকতা বলিতে সাধারণ ভাবে যাহা বোঝায়, তাহা এই অন্ধকার দূর করিতে অক্ষম। দিল্লিতে তাহার আরও এক মর্মান্তিক প্রমাণ মিলিল।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন