দূর অতীত। নিউ মার্কেট, কলকাতা, ১৯৬৫।
১৯৬৪। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পদার্থবিদ্যার অধ্যায় শেষ করে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে পাড়ি দেওয়া। বয়স উনিশ। তখনকার যুগে কলেজের রাজনীতি কোনও সাজানো ঘটনা নয়, কোনও রাজনৈতিক পার্টির নাক গলানোর প্রশ্নই নেই। রাজনীতি মানে বুদ্ধির চর্চা। কাঁচা বয়সে বামঘেঁষা হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমরা বেশির ভাগই ওই রাস্তায় পা দিয়েছি। কিন্তু কোনও বামপন্থী রাজনৈতিক নেতা কিংবা কংগ্রেসের নেতারা কলেজের ধারেকাছে আসার চেষ্টা করেনি। প্রেসিডেন্সি তখন ছিল শিক্ষার মন্দির, রাজনীতির মালিন্য কী করে আসবে? কিন্তু খুবই উচ্চশিক্ষিত যাঁরা নেতা, যেমন অধ্যাপক হীরেন মুখোপাধ্যায়, তাঁরা কলেজের ডিবেটে আসতেন মাঝে মাঝে। তাঁদের অপূর্ব সুন্দর গোটা-গোটা ইংরেজি এবং ডিবেটের আশ্চর্য দক্ষতা ভাবলেই এখনও মনে দোলা দেয়।
আমরা যারা বামের দিকে ঘেঁষে ছিলাম, তাদের দৃঢ় ধারণা জন্মেছিল যে, কমিউনিজমই সমাজের সমস্ত ব্যাধির মহৌষধ। এ ধারণাও হয়েছিল যে, ধনী ব্যবসায়ী মানেই সে চোর কিংবা বাটপাড়, লোক ঠকিয়ে রাতারাতি বড়লোক হয়েছে। আর যে-সব পরিবার বিত্তশালী বহুকাল ধরে, যেমন যারা জমিদার টাইপের, জোর করে খাজনা আদায় করে তারা বিত্তশালী হয়েছে। আমার নিজের পরিবার ওই জাতের। কাজেই বুঝতেই পারছেন যে আমার দৃষ্টিভঙ্গির কী ব্যাকুলতা। নিজের জ্যাঠামশাই, বিধান রায়ের মন্ত্রিসভার সদস্য তিনি। খুব উত্সাহের সঙ্গে জমিদারি বিসর্জন দিয়েছিলেন। তাই ন্যায্যতার ওপর আস্থা হল। যেটা ন্যায্য, সেটাই হবে, সেটাই হওয়া উচিত এমন একটা ধারণা জন্ম নিল।
এ দিকে, নকশাল মুভমেন্টের দামামা বাজতে আরম্ভ করেছে। এই মুভমেন্ট কোথায় গড়াবে, সেটা দেখবার আগেই সাত সমুদ্রের ওপারে পৌঁছে গিয়েছি। বছরখানেক পরেই শীতের ছুটিতে কলকাতায় ফিরে দেখি, কলকাতাকে আর চেনা যায় না। যেন রাতারাতি পাল্টে গেছে। চৌরঙ্গির চেহারা বেমালুম বদলে গিয়েছে। ফার্পোজ উঠে গেছে, সেখানে ছিটের কাপড়ের দোকান বসে গেছে। ফার্পোজ কলকাতার একটা প্রতীক, একটা ল্যান্ডমার্ক। ধনী-গরিবের ব্যাপার নয়। সেখানে অদ্ভুত প্যাটার্নের ছিটের কাপড় ঠিক মানানসই হবে কি? তার পর দেখা গেল, একে একে নিবিছে দেউটি। প্রথম দেখা গেল মার্টিন বার্নস-এর মতো কোম্পানি প্রায় শয্যাশায়ী। আর দু’তিন বছরের মধ্যেই বড় বড় বাঙালি ব্যবসায়ী সংস্থানের লালবাতিও জ্বলে উঠল।
যত বারই কলকাতায় ফিরে এসেছি, চোখে পড়ত কলকাতার কী তাড়াতাড়ি ক্ষয় হচ্ছে। রাস্তাঘাট কিছু দিন আগে পর্যন্ত ঝকঝকে ছিল, ভিস্তিওয়ালা ভোর রাত্রে জল দিত রাস্তা পরিষ্কার রাখার জন্য। পুরনো কালের মহিমময় বাড়িগুলোর আস্তে আস্তে মলিন অবস্থা হল। বড় বড় বাড়িগুলি ভেঙে দেশলাই বাক্সের ফ্ল্যাটবাড়ি বানানো আরম্ভ করল। মায়াপুরী কলকাতা ক্রমশ ঝোপড়পট্টিতে পরিণত হতে থাকল।
সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাজনীতি ঢুকে পড়ল, শিক্ষাকেন্দ্রগুলিতেও। অরাজকতাই স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়াল। ‘চলবে না, চলবে না’ দৈনন্দিন দিনের স্বাভাবিক মনোভাব, তার পর ‘জবাব চাই, জবাব চাই’, ‘আমাদের দাবি মানতে হবে...’ ইত্যাদি। ধীরে ধীরে বাঙালি নেতারা রাজ্যের চোখা-চোখা শিল্পগুলিকে বিদায় দিলেন, শিল্প মানেই তো বুর্জোয়া। দমদম এয়ারপোর্ট প্রায় খালিই হয়ে গেল। কত রকমের, কত রঙেরই উড়োজাহাজ সারা সন্ধে থেকে গভীর রাত্রি পর্যন্ত আসত, আবার উড়ে যেত দেশ-বিদেশে। কারণ, শিল্পজগত্ তখনও গমগম করছে কলকাতায়। এত বিশাল এয়ারপোর্ট দেখতে দেখতে শখের এয়ারপোর্ট হয়ে দাঁড়াল ধূ-ধূ করা মাঠের মতো। অধঃপতনের খোলা রাস্তায় বাংলা হু-হু করে ছুটে চলল। ভাল ছাত্ররা— বাংলায় তাদের কোনও দিনই অভাব নেই— দিল্লি হয়ে সমুদ্র পার। শিক্ষাও সীমাহীন ক্ষয়ের দিকে এগিয়ে চলল চোখ-কান বন্ধ করে।
১৯৫০-এর দশকেও, এমনকী ১৯৬০-এর দশকেও কলকাতাকে অনায়াসে বলা যেতে পারত ভারতবর্ষের সবচেয়ে সেরা শহর, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পের জগতে, লেখাপড়ার জগতে, গান-বাজনার জগতে, কবিতার জগতে, বিজ্ঞানের জগতে, সাহিত্যের জগতে এমনকী জাগতিক বিনোদনের জগতেও। দিল্লি তখন ছিল সরকারি কর্মচারী আর মুষ্টিমেয় নেতাদের শহর। মাদ্রাজ তখনও প্রাচীনের কবলে। বোম্বাই পারসিদের। পনেরো থেকে কুড়ি বছরের মধ্যেই বোম্বাই, মাদ্রাজ, দিল্লি হুসহুস করে এগিয়ে গেল আর কলকাতা অধঃপতনের ঠেলা সামলাতে স্লোগানে মেতে উঠল। কথায় কথায় দিল্লিকে দোষারোপ করেই বাঙালি খালাস। সে দেখেও দেখতে চাইল না যে পায়ের নীচে মাটি সরে গেছে, ফাটল ধরেছে। যত যন্ত্রণা, ততই ব্রিগেডে মিছিল— এই হল নতুন ভাবমূর্তি, নতুন চিন্তাধারা।
১৯৮৪ সালে, কুড়ি বছর পরে যখন কলকাতায় পা রাখলাম কর্মজগতের ডাকে, কলকাতার চেহারা দেখে শিউরে উঠেছিলাম। কোথায় ছিলাম আর কোথায় এলাম! কিন্তু মনে তখনও প্রচুর আশা, এমনকী আহ্লাদ যে, জীবনকে সঁপে দেব, নিষ্ঠার সঙ্গে, সগর্বে, ভিইসিসি (ভেরিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টার) আর এসআইএনপি (সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স)’কে জগত্সভায় নিয়ে যেতেই হবে। হয়তো কিছুটা সাফল্য পেয়েছি জীবনে, কিন্তু দু’চারটি বিচ্ছিন্ন প্রতিষ্ঠান দিয়ে তো আর সারা বাংলাদেশে পরিবর্তন আনা যায় না।
তার পরে দেখা গেল যে, দীর্ঘ চৌত্রিশ বছর রাজত্ব করার পর বাংলাকে দেউলিয়া করে কমিউনিস্ট পার্টি বিদায় নিল। বিচিত্র এই পার্টি। এই একটি মাত্র পার্টি, যাদের পলিটব্যুরো আছে এখনও। যাঁরা পার্টির নেতা, তাঁরা সাধারণ গণমানবের ঊর্ধ্বে। তাঁরা ঠিক করেছেন যে মানুষের কাছে যাওয়ার দরকার নেই, আমিই হচ্ছি সম্রাট। আমিই জানি কোনটা ভাল জনতার জন্য। আমাদের সে সব টোটকা জানা আছে।
হ্যাঁ, পরিবর্তন এল। কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গির কোনও পরিবর্তন এল কি? উল্টো। রাজনীতি এখন রাজনীতি থেকে নেমে গণনীতি, সমাজের সমস্ত সংস্থায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, ইস্কুলে কলেজে কলকাঠি নাড়ছে দাদারা। তাদের রাজনৈতিক দলের নেতা বলব না, তারা হল স্রেফ ‘হামাগো লোক’। অরাজকতা বাংলার চিরকালের পাথেয়, এখন মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে তীব্র ভাবে। কৃষ্টিতে, বাণিজ্যে, শিল্পতে, এমনকী শিল্পজগতেও। এর কোথায় শেষ? আবার নতুন করে দেশ গড়বে কে? সে মানুষেরা কোথায়?
পশ্চিমবঙ্গ একটি ব্যর্থ রাজ্য। বাঙালির মানসিক উত্কর্ষ অবিসংবাদিত, কিন্তু ‘তর্কশীল ভারতীয়’দের মধ্যে বাঙালি হল সবচেয়ে বেশি তর্কশীল। সে শুধু শোরগোল তুলেই চলছে, চলবে। আসলে কিছুই চলছে না, চলবে না। বাংলার সব আছে, কিন্তু আজ তার কিছুই দেওয়ার নেই, এক অন্তহীন নৈরাশ্য ছাড়া।
ভেরিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টার-এ হোমি ভাবা অধ্যাপক