অজস্র অভিযোগ, তবু অস্বাভাবিক কিছু দেখছেন না মমতা

সন্ত্রাসের অভিযোগের বন্যা বয়ে গেল। অথচ, কোথাও কোনও অস্বাভাবিকত্ব নজরে এল না রাজ্যের মুখ্য প্রশাসকের। পুলিশও কার্যত ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে থাকল। চুম্বকে এটাই কলকাতা পুরভোটের কড়চা। বুথ দখল। ভোটারদের ভয় দেখানো। অন্যের হয়ে ভোট দেওয়া। ভোট দিতে না দেওয়া। সচিত্র পরিচয়পত্র কেড়ে নেওয়া। মারধর। বিরোধী দলের নির্বাচনী কার্যালয়ে ভাঙচুর। রাজভবনের মতো ভিভিআইপি এলাকায় বোমাবাজি। ভারতীয় জাদুঘরের সামনে, বাঘাযতীনে এবং পার্ক সার্কাসে গুলি।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০১৫ ১৭:১৬
Share:

সন্ত্রাসের অভিযোগের বন্যা বয়ে গেল। অথচ, কোথাও কোনও অস্বাভাবিকত্ব নজরে এল না রাজ্যের মুখ্য প্রশাসকের। পুলিশও কার্যত ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে থাকল। চুম্বকে এটাই কলকাতা পুরভোটের কড়চা।

Advertisement

বুথ দখল। ভোটারদের ভয় দেখানো। অন্যের হয়ে ভোট দেওয়া। ভোট দিতে না দেওয়া। সচিত্র পরিচয়পত্র কেড়ে নেওয়া। মারধর। বিরোধী দলের নির্বাচনী কার্যালয়ে ভাঙচুর। রাজভবনের মতো ভিভিআইপি এলাকায় বোমাবাজি। ভারতীয় জাদুঘরের সামনে, বাঘাযতীনে এবং পার্ক সার্কাসে গুলি। শনিবার দিনভর অভিযোগের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। আর অভিযোগের আঙুল উঠেছে সেই শাসক দলের দিকেই।

দিনের শেষে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায় জানিয়ে দিলেন, আদর্শ পরিবেশে ভোট হয়নি। যদি তাই হত তবে এত অভিযোগ উঠত না বলে তাঁর দাবি। তিনি জানান, বুথ দখল, ছাপ্পা ভোট, ভোটারদের লাইন থেকে বের করে দেওয়ার মতো অভিযোগ উঠেছে। সচিত্র পরিচয়পত্রও কেড়ে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে। যে পরিবেশে ভোট হয়েছে তাতে সাধারণ মানুষ স্বাধীন ভাবে তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি, এমন অভিযোগও তাঁর কাছে এসেছে। বিকেল ৩টের পরেও কিছু বুথে ভোটারদের লাইন রয়েছে। ৩টে পর্যন্ত ৬০ শতাংশ ভোট পড়েছে।

Advertisement

তবে, মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শনিবার দাবি করেন, যেখান থেকে যা শোনা গিয়েছে সেগুলো যে কোনও নির্বাচনের সময়েই শোনা যায়। এই ধরনের অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ ওঠে। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘বিরোধীরা যে সব জায়গায় এত দিন ভোট করিয়েছে, সেখানে তারা এখন মাথা তুলতে পারছে না। জনগণ তাদের প্রতিহত করছে। তাই তারা গণ্ডগোল পাকিয়ে শাসক দলের উপরেই সেই দায় চাপাচ্ছে।’’ নির্বাচন কতটা শান্তিপূর্ণ হয়েছে তা বোঝাতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, রাস্তাঘাট এত শান্তিপূর্ণ ছিল যে কোথাও কোনও উত্তেজনার ছবিই ছিল না।

যদিও মুখ্যমন্ত্রীর এই শান্তিপূর্ণ পরিবেশের কথা মানতে চাননি বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ। তাঁর দাবি, ৯৯ নম্বর ওয়ার্ডে বিজেপি প্রার্থী শান্তনু সিংহকে লক্ষ করে গুলি ছোড়া হয়। ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে বিজেপি-র এক কর্মকর্তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগও করেন তিনি। তৃণমূল নেতা তথা রাজ্যের মন্ত্রী সাধন পাণ্ডে এবং স্থানীয় তৃণমূল নেতা সাধন সাহার বিরুদ্ধে তিনি অপহরণের অভিযোগ আনেন। রাহুলবাবু বলেন, ‘‘কমিশন যথাযথ দায়িত্ব পালন করেনি। ডব্লিউবিসিএস অফিসার দিয়ে ভোট হয় না। আগে থেকেই ব্লু-প্রিন্ট তৈরি ছিল।’’

এরই পাশাপাশি, বিশাখাপত্তনমে সিপিএমের পার্টি কংগ্রেসে কলকাতায় সন্ত্রাসের প্রতিবাদ করে প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে। পুরভোটে কলকাতায় আক্রান্তদের জন্য নানা ভাষায় স্লোগান দেওয়া হয়েছে। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রের অভিযোগ, দুপুর পর্যন্ত ৩০টি ওয়ার্ডের সব ক’টিই দখল হয়ে গিয়েছে। যেখানে বামেদের অবস্থা তুলনায় ভাল এবং তৃণমূল একটু চাপে, সেখানেই দখল হয়েছে। সন্ত্রাসের অভিযোগ করেও সূর্যবাবু বলেন, ‘‘কলকাতার মানুষ আগের চেয়ে একটু বেশি সক্রিয় হয়েছেন। ৮১টি পুরসভার ভোটে তৃণমূলকে বেশি প্রতিরোধের মুখে পড়তে হবে।’’

শাসক দলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ এনেছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীও। তাঁর দাবি, কলকাতা পুরভোট যে সন্ত্রাসপূর্ণ হবে তা তাঁরা আগেই আশঙ্কা করেছিলেন। সেই আশঙ্কা এ দিন বাস্তবায়িত হয়েছে। কলকাতার মানুষ নির্বিঘ্নে এবং নিশ্চিন্তে ভোট দিতে পারেননি বলে তিনি জানিয়েছেন। তাঁদের প্রার্থীকে পুলিশের সামনে মারধর করে হাত ভেঙে দেওয়া হয়েছে বলেও তাঁর দাবি। এরই পাশাপাশি অধীরবাবু বলেন, ‘‘পুরভোটে তৃণমূল নেত্রীকে এত সন্ত্রাসের উপর নির্ভর করতে হল কেন, বাংলার মানুষ সে প্রশ্ন করবে।’

“বিরোধীরা যে সব জায়গায় এত দিন ভোট করিয়েছে,
সেখানে তারা এখন মাথা তুলতে পারছে না। জনগণ
​তাদের প্রতিহত করছে। তাই তারা গণ্ডগোল পাকিয়ে
শাসক দলের উপরেই সেই দায় চাপাচ্ছে।’’

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

‘‘কলকাতার মানুষ আগের চেয়ে
একটু বেশি সক্রিয় হয়েছেন।
৮১টি পুরসভার ভোটে তৃণমূলকে
বেশি প্রতিরোধের মুখে পড়তে হবে।’’


সূর্যকান্ত মিশ্র

‘‘পুরভোটে তৃণমূল নেত্রীকে
এত সন্ত্রাসের উপর নির্ভর করতে
হল কেন, বাংলার মানুষ সে প্রশ্ন করবে।’’


অধীর চৌধুরী

‘‘কমিশন যথাযথ দায়িত্ব পালন করেনি।
ডব্লিউবিসিএস অফিসার দিয়ে ভোট হয় না।
আগে থেকেই ব্লু-প্রিন্ট তৈরি ছিল।’’


রাহুল সিংহ

ভোটের কলকাতা এ দিন অজস্র অভিযোগের সাক্ষী থেকেছে। শাসক দলের পাশাপাশি প্রশ্ন উঠেছে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও। একের পর এক বুথ দখলের অভিযোগ উঠেছে। ভোটারদের হুমকি দেওয়া হয়েছে। বোমাবাজি হয়েছে। এমনকী, গুলিচালনার ঘটনাতেও পুলিশের নীরব ভূমিকায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন বিরোধী দলের কর্মী-সমর্থকদের পাশাপাশি সাধারণ ভোটাররাও। সংবাদমাধ্যমের কর্মীরাও পুলিশের হাতে অপদস্থ হয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে। তবে, শিয়ালদহের কাছাকাছি হাজিপাড়ায় পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর করার মতো ঘটনাও ঘটে। তবে, পুলিশ কমিশনার সুরজিত্ কর পুরকায়স্থ এ দিন বিকেলে সাংবাদিক বৈঠকে দাবি করেন, গুলিচালনার কোনও ঘটনা ঘটেনি। কয়েকটি জায়গায় বোমাবাজির অভিযোগ এসেছে। তিনি বলেন, ‘‘শুক্রবার থেকেই প্রচুর অভিযোগ এসেছে আমাদের কাছে। অভিযোগ পেয়ে পুলিশ প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে।’’

ভোটের আগের দিন শাসক দলের হাতে হেনস্থা হতে হয় সিপিএম নেতা কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়কে। প্রহৃত হন তাঁর ছেলে সাম্য গঙ্গোপাধ্যায়ও। এ দিনও তাঁকে ধাক্কাধাক্কি করা হয় বলে অভিযোগ। কান্তিবাবুর দাবি, ভোটের নামে কলকাতায় প্রহসন হয়েছে। তবে মমতার পাল্টা অভিযোগ, কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় ও তাঁর ছেলে দু’জনের কেউই নির্বাচনে প্রার্থী নন। তাঁরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে গণ্ডগোল বাধানোর চেষ্টা করেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর আরও অভিযোগ, প্রতিবন্ধী স্কুলকে ঢাল করে কান্তিবাবু যে সব কাজকর্ম করছেন সেগুলি অনেক সময়েই স্বাভাবিক আইনশৃঙ্খলার পরিপন্থী। এ দিন পুরসভার বিদায়ী বিরোধী দলনেত্রী রূপা বাগচিকে ভোটগ্রহণ কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয় বলেও অভিযোগ।

বিধানসভার প্রাক্তন স্পিকার হাসিম আব্দুল হালিমের ছেলে ফুয়াদ হালিম অভিযোগ করেন, তাঁকে লক্ষ করে জাদুঘরের সামনের রাস্তায় তিন-চার রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়। রাজভবন লাগোয়া কাউন্সিল হাউস স্ট্রিটে বোমাবাজির অভিযোগ ওঠে। এই প্রসঙ্গেই মমতা অভিযোগ করেছেন, গুলিচালনার অভিযোগ মিথ্যা। ওঁরাই ওখানে বন্দুক নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন।

রাজাবাজার ট্রাম ডিপোর পাশে টাকি হাউস স্কুলের সামনে ব্যাপক বোমাবাজি চলে। শ্যামবাজারের ভূপেন বসু অ্যাভিনিউ এবং বেনিয়াপুকুর রোডেও বোমা পড়ে বলে অভিযোগ। বড়বাজারে কংগ্রেস প্রার্থীর গাড়ি লক্ষ করে বোমা ছোড়া হয়। ঘটনায় দু’জন আহত হয়েছেন বলে দলীয় সূত্রে খবর। তাঁদের মাড়োয়ারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

বিজেপি-ও শাসক দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে। বেনিয়াটোলায় বিজেপি-র মহিলা কর্মীরা অভিযোগ তোলেন, তাঁদের এক সতীর্থের বাড়িতে হামলা চালিয়েছে তৃণমূল। বাগবাজারে বিজেপি-র নির্বাচনী কার্যালয় ভাঙচুর করা হয়। ৬১ নম্বর ওয়ার্ডে বিজেপি প্রার্থী রাজকুমার সাউ ও তাঁর পোলিং এজেন্টকে মারধর করে তাঁদের সচিত্র পরিচয়পত্র ছিনতাইয়ের অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। তবে, কোথাও কোথাও বিরোধীদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছে।

আর এ সবের মধ্যেই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন বিরোধীরা। আগামী শনিবার, ২৫ এপ্রিল রাজ্যের ৮১টি পুরসভায় নির্বাচন। খাস কলকাতার বুকে যদি ভোটগ্রহণের এই ছবি দেখা যায়, তবে জেলায় জেলায় কী হবে তা নিয়ে আশঙ্কার প্রহর গুনছে তারা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন