বারাসতের রাজীব থেকে সালকিয়ার অরূপ, দুষ্কৃতীরাজ চলছেই

পাঁচ দিনের লড়াই থেমে গেল সোমবার সকালে। কোমা থেকে আর ফিরলেন না সালকিয়ার যুবক অরূপ ভাণ্ডারী। ইভটিজিং-এর প্রতিবাদ করায় বেধড়ক মারধর করা হয়েছিল তাঁকে গত বুধবার রাতে। তার পর থেকে আর জ্ঞান ফেরেনি ওই যুবকের। এই ঘটনা মনে করিয়ে দেয় চার বছর আগে ফেব্রুয়ারিরই এক রাতকে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ১৩:২১
Share:

দুই প্রতিবাদী। রাজীব দাস ও অরূপ ভাণ্ডারী।— ফাইল চিত্র।

পাঁচ দিনের লড়াই থেমে গেল সোমবার সকালে। কোমা থেকে আর ফিরলেন না সালকিয়ার যুবক অরূপ ভাণ্ডারী। ইভটিজিং-এর প্রতিবাদ করায় বেধড়ক মারধর করা হয়েছিল তাঁকে গত বুধবার রাতে। তার পর থেকে আর জ্ঞান ফেরেনি ওই যুবকের। এই ঘটনা মনে করিয়ে দেয় চার বছর আগে ফেব্রুয়ারিরই এক রাতকে।

Advertisement

সেটা ছিল ২০১১-র ১৪ ফেব্রুয়ারি। ঘটনাস্থল উত্তর ২৪ পরগনার জেলা সদর বারাসত। ওই রাতে দিদি রিঙ্কু দাসকে নিয়ে বারাসত স্টেশন থেকে সাইকেলে করে ফিরছিলেন ভাই রাজীব দাস। পথে জেলাশাসকের দফতরের কাছে মদ্যপ কিছু দুষ্কৃতী ভাই-বোনের রাস্তা আটকায়। রিঙ্কুকে কটূক্তি করার পর তাঁর গায়ে মদ ঢেলে দেওয়া হয়। এমনকী, ভাই-বোনকে শুনতে হয়, ‘রাতে প্রেম করে ফেরা হচ্ছে? ভ্যালেন্টাইনস ডে!’ প্রতিবাদ করায় মারধর শুরু হয় রাজীবের উপর।

ঘটনাস্থলের কয়েক শো মিটারের মধ্যেই অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের বাংলো। সেই বাংলোর সিপাইদের কাছে ভাইকে বাঁচানোর আর্তি নিয়ে দৌড়ে যান রিঙ্কু। কিন্তু দায়িত্ব ফেলে সেখানে যাননি কর্তব্যরত কোনও পুলিশকর্মী। থানার নম্বর দিয়েই দায় এড়ান তাঁরা। এর পরই দিদি দেখতে পান, রক্তাক্ত ভাইকে ভ্যানে করে নিয়ে আসছে কারা। ছুরিবিদ্ধ রাজীবের পেট থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে তখন। বারাসত জেলা হাসপাতাল ঘুরিয়ে রাজীবকে নিয়ে যাওয়া হয় আরজিকর-এ। সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।

Advertisement

একই রকম ভাবে প্রতিবাদ করেছিলেন সালকিয়ার অরূপ। গত ২৮ জানুয়ারি রাতে সরস্বতী পুজোর ভাসানে যাওয়ার সময় তিনি দেখেছিলেন রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েক জন তরুণীকে উত্ত্যক্ত করছে এক দল যুবক। এমনকী, তাঁদের গায়েও হাত দেওয়া হচ্ছে। অরূপ সেই ঘটনার প্রতিবাদ করেন। বচসা বাধে। কিন্তু, তখনকার মতো বিষয়টি মিটেও যায়। বিসর্জন দিয়ে ফেরার পথে ওই যুবকেরাই অরূপ এবং তাঁর বন্ধু অভিজিতকে আটকে বেধড়ক মারধর করে। অভিযোগ, রাস্তায় ফেলে লোহার রড দিয়ে তাঁর মাথায় মারা হয়। গুরুতর জখম অবস্থায় তাঁকে ভর্তি করা হয় কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে। কোমায় চলে যাওয়া ওই যুবককে রাখা হয় ভেন্টিলেশনে। কিন্তু, কোনও কিছুই তাঁকে আর বাঁচাতে পারেনি। ঘটনার পাঁচ দিন পরে অরূপের মৃত্যু হলেও এখনও পর্যন্ত দোষীদের সকলেই অধরা। পুলিশের বিরুদ্ধে উঠেছে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ।

রাজীব হত্যা-কাণ্ডেও পুলিশের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ উঠেছিল। খাস জেলা সদরে, জেলাশাসক-পুলিশ সুপার-অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের বাংলোর কয়েক শো মিটারের মধ্যে ওই ঘটনা ঘটে। পরে যদিও রাজীব হত্যার মূল তিন অভিযুক্ত গ্রেফতার হয়। মামলা এখনও চলছে। সেই বিচারপর্ব শেষ হওয়ার আগেই একই রকম ভাবে অরূপের মৃত্যু প্রমাণ করল, রাজ্য যে তিমিরে ছিল আছে সেখানেই।

মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী রাজীবের মৃত্যু সেই সময় রাজ্য রাজনীতিকে তোলপাড় করেছিল। ঘটনার পর দিনই বারাসতে তাঁদের বাড়িতে গিয়েছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। রিঙ্কুর মা গায়ত্রীদেবীকে তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন, ‘দোষীরা শাস্তি পাবেই।’ এমনকী, রিঙ্কুকে তিনি বাবাকে সঙ্গে নিয়ে দু’-এক দিন পরে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেছিলেন। পরে মহাকরণে দাঁড়িয়ে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ওই পরিবারকে দু’লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের কথা ঘোষণা করেন। জেলাপরিষদে গায়ত্রীদেবীকে একটি চাকরির ব্যবস্থাও করে দেয় বাম-সরকার। ওই দিন রাজীবদের বাড়ি থেকে বুদ্ধবাবু বেরোনোর পর পরই সেখানে হাজির হয়েছিলেন তৃণমূল নেতৃত্ব। সেই দলে ছিলেন সৌগত রায়, কাকলি ঘোষ দস্তিদার এবং জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। রিঙ্কুর হাতে কুড়ি হাজার টাকা তুলে দিয়ে তাঁরা বলেছিলেন, “এটা মমতাদি পাঠিয়েছেন। এই পরিবারের এক জনের চাকরির ব্যবস্থা তিনি করবেন। পরিবারের সমস্ত দায়িত্ব এখন দিদিরই।”

ঘটনাচক্রে সেই ‘দিদি’ই এখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। বুধবার রাতে অরূপকে মারধর করার পর থেকে এ দিন দুপুর পর্যন্ত সরকার বা তৃণমূলের তরফে ওই পরিবারের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করা হয়নি। তবে দুপুর একটা নাগাদ নিহতের বাড়িতে আসেন রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ রায়। মুখ্যমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে তিনি জানান, সরকার এই পরিবারের পাশে আছে। অপরাধীরা যেখানেই থাকুক না কেন, তাদের খুব শীঘ্রই গ্রেফতার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন