সৌজন্য: ফেসবুক।
ড্যানিয়েল পার্লের পরে জেমস ফোলেই। অপহরণকারীদের হাতে প্রাণ গেল আর এক মার্কিন সাংবাদিকের। এ বারের হত্যার জন্য দায়ী ইসলামিক স্টেট (আইএস)— এর জঙ্গিরা। এর আগে পাকিস্তানে অপহৃত হয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন ‘ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল’-এর সাংবাদিক পার্ল। মার্কিন প্রশাসনের তরফ থেকে জানানো হয়েছে তারা ইতিমধ্যেই ফোলেই-এর হত্যার খবরের সত্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু করেছে।
মঙ্গলবার ইউটিউবে আইএস-এর পক্ষ থেকে ‘আ মেসেজ টু আমেরিকা’ নামে একটি ভিডিও প্রকাশ করা হয়। সেখানে দেখা গিয়েছে, কমলা রঙের পোশাক পরা এক ব্যক্তি হাঁটু মুড়ে বসে আছেন। আইএস জানিয়েছে, এই ব্যক্তিই অপহৃত সাংবাদিক ফোলেই। পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে মুখঢাকা, কালো পোশাক পরা এক জঙ্গি। যার হাতে একটি ছুরিও রয়েছে।
ভিডিওটির শুরুতেই ওই জঙ্গি ব্রিটিশ উচ্চারণে ফোলেই-র পরিচয় দেয়। এর পরে ফোলেই একটি বিবৃতি পড়ে শোনান। সেখানে বলা হয়, তাঁর মৃত্যুর জন্য আসলে আমেরিকাই দায়ী। আমেরিকার উদাসীনতা ও অন্যান্য অপরাধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে তাঁর পরিবার ও আমেরিকার সাধারণ নাগরিকদের কাছে ফোলেই আবেদন জানান। ভিডিওতে শোনা গিয়েছে, তিনি আর সময় পাচ্ছেন না বলে দুঃখপ্রকাশ করছেন। মুক্ত হয়ে নিজের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে পারলেন না বলেও আক্ষেপ করতেও শোনা যায় তাঁকে। এর পরে ভিডিওতে দেখা যায়, ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে আমেরিকার বিমান হানার প্রতিবাদে ফোলেই-র মুণ্ডচ্ছেদ করা হচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় পাঁচ বছর ধরে কাজ করছেন ফোলেই। ২০১২-র ২২ নভেম্বর সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমে, তুরস্ক সীমান্তের কাছে অপহৃত হন তিনি। তখন তিনি ‘গ্লোবাল পোস্ট’ নামে একটি মার্কিন অন-লাইন সংবাদমাধ্যমে কাজ করতেন। এর আগে তিনি সংবাদ সংস্থা এএফপি-তে কাজ করেছেন। তাঁকে বন্দুক দেখিয়ে জোর করে একটি গাড়িতে তুলে নেওয়া হয়েছিল। এর পরে তাঁর কোনও খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। ফোলেই অবশ্য এর আগেও অপহৃত হয়েছেন। ২০১১ সালে লিবিয়ায় কাজ করার সময়ে গদ্দাফির অনুগামীরা তাঁকে অপহরণ করে। সেখানে ছ’সপ্তাহ বন্দি থাকার পরে মুক্তি পান। তাঁর এ বারের অপহরণের পরে বন্ধু ও সহকর্মীরা মিলে ‘ফ্রি জেমস ফোলেই’ নামে একটি ফেসবুক পেজ তৈরি করেন। ফোলেই-এর হত্যার সংবাদ প্রকাশ্যে আসার পরে সেখানে একটি পোস্টে ফোলেই—এর মা ডিয়ানে লিখেছেন, ছেলের জন্য তাঁর আজ সবচেয়ে বেশি গর্ববোধ হচ্ছে। তাঁর ছেলে সিরিয়ার মানুষদের যন্ত্রণার কথা বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছিলেন। পাশাপাশি বন্দি নিরাপরাধ সাংবাদিকদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিও তিনি করেছেন।
ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের মুখপাত্র ক্যাটলিন হেইডেন জানান, ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য গোয়েন্দা আধিকারিকেরা ভিডিওটি খুঁটিয়ে দেখে বিশ্লেষণের চেষ্টা করছেন। অন্য অনেক জায়গা থেকেও তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। ঘটনাটি সত্য হলে, নৃশংস ভাবে নিরীহ মার্কিন সাংবাদিককে হত্যার জন্য হেইডেন ঘৃণাপ্রকাশ করেন। পাশাপাশি, ফোলেইয়ের পরিবারের প্রতি সমবেদনাও জানান তিনি। এ বিষয়ে আরও তথ্য এলে তা প্রকাশ করার আশ্বাসও দেওয়া হয়েছে। অন্য দিকে, হোয়াইহাউস সূত্রে খবর, প্রেসিডেন্ট ওবামাকে খবরটি জানানো হয়েছে। নতুন সব তথ্যই তাঁকে দেওয়া হচ্ছে।
ওই একই ভিডিওতে দেখানো হয়েছে স্টিভেন সোটলোফ নামের আর এক সাংবাদিককে। ইরাকে বিমান হানা বন্ধ না করলে তাঁরও একই দশা হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পরবর্তী পদক্ষেপের উপরে স্টিভেন-এর জীবন নির্ভর করছে। স্টিভেন ‘টাইম ম্যাগাজিন’ এবং ‘ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন’-এ লিখতেন। ২০১৩ সালে সিরিয়া-তুরস্ক সীমান্ত থেকে তিনি অপহৃত হন। ‘কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্ট’ নামের একটি সংগঠন সূত্রে খবর, সিরিয়া ও ইরাকের যুদ্ধের সংবাদ করতে গিয়ে প্রায় ২০ জন সাংবাদিক অপহৃত হয়েছেন। এর মধ্যে আছেন ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’-এর মার্কিন সাংবাদিক অস্টিন টিসও। ২০১২-তে সিরিয়ায় কাজ করার সময়ে তিনি অপহৃত হন। তার পরে তাঁরও কোন সংবাদ পাওয়া যায়নি।
এই ছবিই প্রকাশ পেয়েছে ইউটিউবে। ইনসেটে ফোলেই।
‘ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল’-এর সাউথ-এশিয়া ব্যুরোর প্রধান সাংবাদিক ড্যানিয়েল পার্ল কাজের সুবাদে মুম্বইয়ে থাকতেন। ২০০১ সালে প্যারিস থেকে মায়ামিগামী আমেরিকান এয়ারলাইনস-এর ফ্লাইট ৬৩ তে বিস্ফোরণ ঘটাতে গিয়ে ধরা পড়ে জঙ্গি রিচার্ড রেইড। জুতোতে বিস্ফোরক বহন করছিল সে। এই জঙ্গির সঙ্গে আল-কায়দার যোগসূত্র আছে কিনা সেই সংক্রান্ত খবর করতে পাকিস্তান যান পার্ল। সেখানেই আল-কায়দার জঙ্গিরা তাঁকে প্রথমে অপহরণ এবং পরে হত্যা করে। তাঁকে হত্যার অপরাধে ২০০২ সালে পাকিস্তানে আল-কায়দা জঙ্গি আহমেদ ওমর সৈয়দ শেখ-এর ফাঁসি হয়। ধরা পড়ে মূল অভিযুক্ত খালিদ শেখ মহম্মদও। কিউবার গুয়ানতানামো বে-এর সেনা আদালতে বিচারের সময়ে ড্যানিয়েল পার্ল হত্যার দায় খালেদ শেখ মহম্মদ স্বীকার করে নেয় বলে খবর।
ফোলেই যখন অপহৃত হন, তখন সিরিয়ার আইএস সংগঠনটির অস্তিত্ব ছিল না। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর মধ্যে বেশ কয়েক বার ফোলেই-এর হাতবদল হয়েছে। সেখানে অর্থের বিনিময়ও হয়ে থাকতে পারে। শেষ পর্যন্ত ফোলেই আইএস জঙ্গিদের কব্জায় আসেন। মার্কিন বিমান হানার আর কোনও ভাবে মোকাবিলা করতে না পেরে আইএস জঙ্গিরা ফোলেইকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয় বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা। এর আগে মুণ্ডচ্ছেদ করে হত্যার আরও অভিযোগ আইএস জঙ্গিদের বিরুদ্ধে উঠেছে। উঠেছে গণহত্যার অভিযোগও। শুধু অন্য সম্প্রদায় (ইয়াজিদি উপজাতি) বা শিয়ারাই নন, তাদের হাতে এ ভাবে প্রাণ গিয়েছে সুন্নিদেরও।