Lok Sabha Election 2024

কেন তিনি বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে? মুকুটমণির মনের ক্ষোভ আর হতাশা শুনল আনন্দবাজার অনলাইন

মুকুটমণি অধিকারী যে বিজেপিতে থাকবেন না সেটা আগে থেকেই আন্দাজ করেছিলেন রাজ্য বিজেপির নেতারা। তবে তাপস রায়ের যোগদানের পরের দিনই দলবদল হবে সেটা ভাবা ছিল না।

Advertisement

পিনাকপাণি ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২৪ ১১:৩০
Share:

মুকুটমণি অধিকারী। —ফাইল চিত্র।

লোকসভা নির্বাচন ২০১৯। রানাঘাট আসন থেকে ‘চিকিৎসক’ ও ‘মতুয়া’ মুকুটমণি অধিকারী যে বিজেপি প্রার্থী হচ্ছেন, সেটা পাকাই ছিল। কিন্তু সেই সময়ে সরকারি হাসপাতালে চাকরি করার কারণে দরকার ছিল নবান্নের ছাড়পত্র। পাননি। তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ নিয়েই রানাঘাট লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থী জগন্নাথ সরকারের সমর্থনে ভোটের কাজে নেমেছিলেন।

Advertisement

বিধানসভা নির্বাচন ২০২১। সরকারি ছাড়পত্র পেয়ে চাকরি ছেড়ে বিধায়ক হন মুকুটমণি। রানাঘাট দক্ষিণ আসনে তাঁর হয়ে প্রচার করেছিলেন সাংসদ জগন্নাথ। সে বার জগন্নাথও ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন শান্তিপুর বিধানসভা আসনে। সেখানেও মতুয়া ভোট টানতে প্রচারে যান মুকুমণি। দু’জনেই জেতেন। যদিও পরে জগন্নাথ বিধায়ক পদ না নেওয়ায় উপনির্বাচনে শান্তিপুরের দখল পায় তৃণমূল।

লোকসভা নির্বাচন ২০২৪। সব ঠিক থাকলে তিনিই রানাঘাটে তৃণমূলের প্রার্থী হবেন বলে বিশ্বাস মুকুটমণির ঘনিষ্ঠদের। একেবারে ১৮০ ডিগ্রি বাঁক। বিজেপি আগেই জগন্নাথের নাম প্রার্থী হিসাবে ঘোষণা করে দিয়েছিল। মুকুটমণির ভাগ্যে টিকিটের শিকে না ছিঁড়তেই বেঁকে বসেন তিনি। দলের রাজ্য নেতাদের বলতে শুরু করেন, ‘‘রানাঘাট আসন জেতা যাবে না। জগন্নাথ সরকারকে কেউ ভোট দেবে না।’’

Advertisement

তার পরে পরেই সকলকে চমকে দিয়ে মুকুটমণি যোগ দিলেন তৃণমূলে। প্রথমে ঠিক ছিল, তিনি রবিবার তৃণমূলের ব্রিগেড সমাবেশের মঞ্চেই ‘চমক’ দেবেন। কিন্তু বুধবার তৃণমূলের প্রাক্তন বিধায়ক তাপস রায় বিজেপিতে যেতেই পরের দিন মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে ঘাসফুলের পতাকা হাতে নিয়ে নিলেন। এই যোগদান আচমকা হলেও বিজেপির রাজ্য বা কেন্দ্রীয় নেতারা এর জন্য তৈরিও ছিলেন। ফলে এই ঘটনা ততটা ‘চমক’ বয়ে আনেনি তাঁদের কাছে। মুকুটমণিকে যে ধরে রাখা যাবে না, সেটা অনেক আগে থেকেই আন্দাজ করেছিল বিজেপি।

কিন্তু কেন বিজেপি ছাড়লেন তিনি? জবাবে আনন্দবাজার অনলাইনকে অনেক রাগ, ক্ষোভ, হতাশার কথা জানালেন মুকুটমণি। বললেন, ‘‘বিজেপি জগন্নাথ সরকারকে প্রার্থী করে জনমতকে উপেক্ষা করেছে। যাঁর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আর তাতে নানা দুর্নীতির গন্ধ।’’ তা হলে প্রার্থী হতে না পারার জন্যই দলবদল? মুকুটমণির জবাব, ‘‘আসলে যে নীতি-আদর্শের উপরে দাঁড়িয়ে বিজেপির পক্ষ থেকে নদিয়াবাসীর জন্য যে লড়াই আমরা করছিলাম, সেখানে দেখেছি আদর্শচ্যুত বঙ্গ বিজেপি। জনমত এবং সাধারণ মানুষের রায়কে উপেক্ষা করে জগন্নাথ সরকারের মতো এক জনকে প্রার্থী করা হয়েছে।’’

তা হলে তৃণমূল তাঁকে প্রার্থী করবে, এই প্রতিশ্রুতি পেয়েই দলবদল করলেন? সরাসরি তা না মানলেও স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন মুকুটমণি। বলেছেন, ‘‘দুর্নীতির বিরুদ্ধেই তো বঙ্গ বিজেপির লড়াই ছিল! কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগ থাকা জগন্নাথ সরকারকেই প্রার্থী করা হল। রানাঘাটের মানুষও সেটা চাননি। আমি নদিয়া থেকে সেই দুর্নীতিগ্রস্ত লোকটাকে সরাতেই তৃণমূলে যোগ দিয়েছি। নদিয়াকে অশান্তির হাত থেকে বাঁচাতেই বিজেপি ছাড়লাম।’’

এমন ক্ষোভের কথা কি নেতৃত্বকে জানিয়ে দলের ভিতরে আলোচনা করা যেত না? মুকুটমণি বলেন, ‘‘সবাই সব জানেন। আমি নিজেও বলেছি। সকলে ওয়াকিবহাল। আর আমি তো মনে করি, রাজ্য নেতৃত্বের রিপোর্টের ভিত্তিতেই কেন্দ্রীয় নেতারা ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’’ অনেক দিন ধরে ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন। দলবদলের জল্পনাও চলছিল। তার পরেও তাঁর সঙ্গে রাজ্য নেতৃত্ব যোগাযোগ করেননি? মুকুটমণির জবাব, ‘‘নেতৃত্ব এ বিষয়ে উদাসীনই থেকেছেন।’’ তবে রানাঘাটের প্রার্থী হিসাবে জগন্নাথের নাম ঘোষণার পরে আর শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলেননি মুকুটমণি। কারণ, তিনি বলছেন, ‘‘চোর পালালে আর বুদ্ধি বাড়িয়ে কী লাভ?’’

রাজ্য রাজনীতিতে মতুয়া ভোটের অঙ্ক সব দলই কষে। রানাঘাট আসনে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভোটার মতুয়া সম্প্রদায়ের। মতুয়া ভোট কি বিজেপির পক্ষেই থাকবে না মুকুটমণি তাতে ভাগ বসাবেন? জবাবে রানাঘাট দক্ষিণের বিধায়ক বলেন, ‘‘রানাঘাট আসনে মতুয়া সম্প্রদায়ের কাউকে প্রার্থী না করে যে ভাবে এক জন অযোগ্যকে প্রার্থী করা হয়েছে, আমি মনে করি তাতে বিজেপির ক্ষতি হবে। আর শুধু মতুয়া নয়, সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষই আমার সঙ্গে থাকবেন।’’

শুধু বিধায়ক করাই নয়, বিজেপি আরও বড় সম্মান দিয়েছিল মুকুটমণিকে। তাঁকে দলের জাতীয় কর্মসমিতির সদস্য করা হয়। বিজেপি সেই সময় দাবি করেছিল, মতুয়া হিসাবে নয়, এক জন শিক্ষিত, চিকিৎসক তরুণ হিসাবেই তাঁকে কমিটিতে জায়গা দেওয়া হয়েছে। ৩৩ বছরের মুকুটমণি এখনও ওই কমিটির সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। রাজ্য বিজেপিও ২০২২ সালে তাঁকে রাজ্যের তফসিলি মোর্চার ‘ইনচার্জ’ ঘোষণা করে। একই সঙ্গে তিনি মতুয়া মহাসঙ্ঘের জেলা ও রাজ্যের পদ পান। বিজেপি পরে তাঁকে দলের উদ্বাস্তু শাখার সহ-আহ্বায়কও করেছিল। তবে মুকুটমণি জানাচ্ছেন, খুব তাড়াতাড়িই বিজেপির সমস্ত পদ থেকে ইস্তফা দেবেন। বিধায়ক পদ ছাড়বেন কি না, তা ঠিক করবে তাঁর নতুন দল।

২০২৩ সালে একটি বিতর্কে জড়িয়েছিলেন মুকুটমণি। বিয়ের মাত্র ১১ দিনের মাথায় তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ দায়ের করেন স্ত্রী কলকাতার বাসিন্দা স্বস্তিকা ভুবনেশ্বরী। তিলজলা থানার সেই মামলা এখনও মেটেনি। বিতর্ক তৈরি হওয়ার সময়ে বিজেপি মুকুটমণির পাশেই দাঁড়িয়েছিল। সেই সময়ে এ-ও বলা হয়েছিল যে, এর পিছনে তৃণমূল রয়েছে। তবে মুকুটমণি নিজে ঘনিষ্ঠদের বলেছিলেন, সাংসদ জগন্নাথই তাঁকে ফাঁসিয়েছেন। ফলে জগন্নাথ-মুকুটমণি লড়াই নতুন নয়। এখন বিজেপি নেতারা সেই মামলার প্রসঙ্গ টেনে আক্রমণ করছেন তাঁকে। তবে মুকুটমণি ওই প্রসঙ্গে একটি শব্দও খরচ করতে রাজি নন। তিনি বলেন, ‘‘এ রাজ্যের অনেক সম্মাননীয় নেতা রয়েছেন, যাঁদের বিরুদ্ধে ভূরি ভূরি অভিযোগ রয়েছে। নদিয়াবাসী জানেন আমি কেমন। আমার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ কেউ বিশ্বাস করবেন না।’’

যে জগন্নাথের বিরুদ্ধে এত রাগ মুকুটমণির, তিনি কী বলছেন? মুকুটমণির বিদায়ে ‘খুশি’ জগন্নাথের দাবি, ‘‘মুকুটমণি অধিকারী দলে থাকলে চার লক্ষ ভোটে জিততাম। এ বার ব্যবধান বেড়ে পাঁচ লক্ষ হবে। ভিতরে থেকে তিনি এক লক্ষ ভোটের ক্ষতি করতেন। সেই সুযোগ আর পাবেন না। নিজের স্ত্রীর সঙ্গে যিনি প্রতারণা করেছেন, তিনি আর যাই হোক মতুয়া সম্প্রদায়ের নেতা হতে পারেন না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
আরও পড়ুন