সল্টলেকে আধা সামরিক বাহিনীর টহল। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, কেন্দ্রীয় সরকার কোনও সাহায্যই করছে না। সব টাকা নাকি কেটে নিয়ে চলে যাচ্ছে। এক বার নয়, বার বার বলছেন মুখ্যমন্ত্রী। বাস্তবটা কিন্তু ঠিক উল্টো। কয়েকটি নির্দিষ্ট প্রকল্পে বাংলার বরাদ্দ হয়তো কমানো হয়েছে। কিন্তু, তার পরিমাণ সামান্যই। তার বদলে নির্দিষ্ট প্রকল্পের বাইরে রাজ্যের জন্য যে বরাদ্দ, তার পরিমাণ অনেকটা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্র জানিয়েছে, রাজ্য নিজের প্রয়োজনীয়তা বুঝে ঠিক করে নিক, কোন খাতে কত টাকা বরাদ্দ করবে। অর্থাৎ, প্রকল্পের জন্য বরাদ্দের পরিমাণ নির্দিষ্ট না করে অতিরিক্ত টাকা ইচ্ছে মতো খরচ করার স্বাধীনতা রাজ্য সরকারকে দেওয়া হয়েছে। এমন বিরাট সুবিধা পশ্চিমবঙ্গকে পাইয়ে দেওয়া সত্ত্বেও রাজ্যবাসীকে তার সুফল পেতে দিল না তৃণমূল। উপরন্তু মুখ্যমন্ত্রী বার বার অভিযোগের আঙুল তুলছেন। বলছেন, বঞ্চনা হচ্ছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অসত্য ভাষণ নিজের ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা ছাড়া কিছুই নয়।
এখন রাজ্য সরকার দান-খয়রাতি আর উপহার, উপঢৌকনের রাজনীতিতে মেতেছে। সবাইকে কিছু না কিছু পাইয়ে দিয়ে ভোট বৈতরণী পার হওয়ার চেষ্টা। প্রশাসনিক কাজকর্মে সার্বিক ব্যর্থতা না থাকলে এমন নির্লজ্জ ঘুষের রাজনীতিতে কেউ মেতে ওঠে না। সারা দেশ দেখছে, পশ্চিমবঙ্গ ১০০ দিনের কাজে প্রথম হচ্ছে। সুব্রত মুখোপাধ্যায় দিল্লিতে গিয়ে পুরস্কার নিয়ে আসছেন। আর নিজের চোখে আমি দেখছি, গ্রামে গ্রামে জেসিপি দিয়ে মাটি কাটার কাজ চলছে। ঝুড়ি-কোদাল হাতে শ্রমিকের দেখা নেই। অর্থাৎ, রাজ্যের মানুষ কাজ পাচ্ছে বলে কেন্দ্রের কাছে রিপোর্ট পৌঁছচ্ছে। মাটি কাটার কাজ হয়েছে বলে দেখানোও হচ্ছে। কিন্তু সে কাজ সাধারণ শ্রমিক করছেন না। সে কাজ অন্য কেউ মেশিন চালিয়ে দ্রুত সেরে ফেলছে। সব পয়সা তারাই নিয়ে চলে যাচ্ছে। জায়গা মতো সব ভাগাভাগি হয়ে যাচ্ছে। আর কেন্দ্রীয় সরকারকে জানানো হচ্ছে, গ্রামের মানুষকে কাজ দেওয়া হয়েছে, তাঁদের অন্নের সংস্থান করা হয়েছে।
এ রাজ্যের ৭ কোটি মানুষকে ২ টাকা কিলো দরে চাল দেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকার খাদ্য সুরক্ষা প্রকল্প চালু করেছে। তার আওতায় পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে সব রাজ্যের গুদামে। বাংলার সরকার সেই চাল ৭ কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। খুব ভাল কথা। গরিব মানুষ ২ টাকা কিলো দরে চাল পেলে কারও আপত্তির কিছু থাকতে পারে না। কিন্তু ২ টাকা কিলো দরে চাল নিতে ৭ কোটি মানুষ কেন লাইন দিচ্ছেন রেশন দোকানের সামনে? এ রাজ্যের মানুষের আর্থিক অবস্থা তা হলে কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, আমরা সবেতেই এক নম্বর। আমরা আর্থিক বৃদ্ধিতে এক নম্বর, আমরা মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পে এক নম্বর, আমরা কৃষিতে এক নম্বর, আমরা কর্মসংস্থানে এক নম্বর। সব কিছুতে যদি প্রথম স্থানে থাকি, রাজ্যের অর্থনীতি যদি এত দ্রুত এগোতে থাকে, এত কর্মসংস্থান যদি হয়ে গিয়ে থাকে, তা হলে ৭ কোটি মানুষকে ২ টাকা কিলো দরে চাল নেওয়ার জন্য হাপিত্যেশ করে বসে থাকতে হচ্ছে কেন?
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এমন ভয়ঙ্কর অবনতি পশ্চিমবঙ্গ শেষ কবে দেখেছে? পুলিশ-প্রশাসনকে দুষ্কৃতীরা পাত্তাই দেয় না। কারণ তারা জানে, মাথার উপর তৃণমূলের হাত রয়েছে। সাধারণ মানুষের আর প্রশাসনে আর আস্থা নেই। কারণ তাঁরা জানেন, প্রশাসন কোনও সমস্যারই সমাধান করবে না। আসলে পুলিশ-প্রশাসনকে ঠুঁটো জগন্নাথ করে রাখা হয়েছে। স্পষ্ট নির্দেশ, শহরে-শহরে, গ্রামে-গ্রামে, পাড়ায়-পাড়ায়, গলিতে-গলিতে তৃণমূলকে যা খুশি তাই করতে দিতে হবে। শাসক দলের কর্মীর কেশাগ্র স্পর্শ করা যাবে না। তৃণমূল নেতা বা কর্মীদের চটালেই পুলিশ বা প্রশাসনের কর্তাদের উপর শাস্তির খাঁড়া নামছে বা বদলি হতে হচ্ছে। তৃণমূলকে না চটিয়ে যে পুলিশ শান্তিতে নিদ্রা যাবে, সে উপায়ও নেই। কারণ পুলিশি হাঙ্গামা থেকে রক্ষা পেয়েই তৃণমূল সমর্থকরা খুশি থাকতে পারছেন না। নিজেদের দাপট রাজ্যের মানুষকে টের পাইয়ে দিতে মাঝেমধ্যেই থানায় বা প্রশাসনিক ভবনে ঢুকে পুলিশ বা সরকারি কর্তাদের মারধর করে আসছে তৃণমূল। যেখানে সেখানে আক্রান্ত হচ্ছে পুলিশ।
প্রত্যেক এলাকায় যুব সম্প্রদায়কে সঙ্গে রাখতে সিভিক ভলান্টিয়ার হিসেবে হাজার হাজার যুবককে নিয়োগ করা হয়েছে। তাদের দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করছে তৃণমূল। সিভিক ভলান্টিয়ারদের আনুগত্য ধরে রাখতে বেতন বাড়ানোর কথা ঘোষণা করা হচ্ছে। কিন্তু বেতন বাস্তবে বাড়ছে না।
বিজেপি এখন পশ্চিমবঙ্গের সামনে একমাত্র বিকল্প। কংগ্রেস এবং সিপিএম এ রাজ্যের মসনদে ইতিমধ্যেই পরীক্ষিত। তাদের ছুঁড়ে ফেলেছে বাংলা। তার হাত মিলিয়েছে। কিন্তু লাভ হবে না। একটা ইংরেজি প্রবচন রয়েছে— ‘Two vanquished cannot make any victor.’ মানুষ মুখ ফিরিয়েছে যাদের দিক থেকে, তারা পরস্পরের মধ্যে হাত মেলালে কী-ই বা যায় আসে?
তৃণমূলকে চেনা ছিল না। গত পাঁচ বছরে সে অভিজ্ঞতাও হয়ে গেল বাংলার। মানুষ গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা চেয়ে ভোট দিয়েছিলেন ২০১১ সালে। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে বাংলা দেখেছে, এ রাজ্যে ৩৪ বছরের বাম শাসনে গণতন্ত্রের যে ক্ষয়িষ্ণু চেহারা তৈরি হয়েছিল, তাতে আরও ধংসাত্মক আঘাত হানতে শুরু করেছে তৃণমূল। গণতন্ত্রকে ধ্বংসস্তূপে বদলে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই জাল এ বার বাংলা কাটতে চাইছে।
তৃণমূল অবশ্য শুধু বাংলাকে জালে জড়িয়ে থেমে থাকতে পারেনি। নিজেদের জালে নিজেরাও জড়িয়েছে। নারদ নিউজের স্টিং ভিডিও সামনে আসার পর জবাব খুঁজে পাচ্ছে না তৃণমূল। ২০০১ সালে জর্জ ফার্নান্ডেজের নাম ঘুষ কাণ্ডে জড়াতেই তোলপাড় শুরু করে দিয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী। জর্জকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও সরকারে থাকেননি মমতা। রেল মন্ত্রক থেকে পদত্যাগ করে বাংলায় ফিরে এসেছিলেন কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়তে। তৃণমূল কলকাতার মোড়ে মোড়ে ব্যানার লাগিয়েছিল— ‘ক্ষমতা নয় সততা, দেখিয়ে দিল মমতা।’ এ বারের স্টিং ভিডিও নিয়ে তা হলে মমতা চুপ কেন? সে বার তো মমতা অপেক্ষা করেননি স্টিং ভিডিওর সত্যাসত্য প্রমাণের জন্য! অভিযোগ উঠতেই ধরে নিয়েছিলেন, ১০০ শতাংশ খাঁটি সে অভিযোগ। এ বার নিজের দলের ডজন খানেক নেতার টাকা নেওয়ার ছবি প্রকাশ্যে আসার পরও, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কেন মনে হচ্ছে না যে দুর্নীতিগ্রস্তদের সরিয়ে দেওয়া দরকার! এখনই দরকার! অবস্থান স্পষ্ট করার দায় তৃণমূলেরই। এ নিয়ে যত দূর যেতে হয়, আমরা তত দূরই যাব। ছেড়ে কথা বলা হবে না। বাংলার মানুষও ছেড়ে কথা বলবেন না।