সীতারাম ইয়েচুরির সঙ্গে আমি যখন প্রথম জোট নিয়ে কথা বলা শুরু করলাম, তাতে অনেকে আশ্চর্য হয়েছিলেন। বিস্মিত হয়ে আমাকে বলেছিলেন, এ আবার হয় নাকি! কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিএমের জোট? কেউ আমার কাছে বিস্ময় প্রকাশ করছিলেন। কেউ সিপি জোশীর কাছে গিয়ে বলছিলেন, এই জোট অসম্ভব। সে সবে আমরা কান দিইনি। জোট নিয়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা চালিয়ে গিয়েছি। কথাবার্তা যত এগোল, ততই স্পষ্ট হল, কতটা সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত আমরা নিয়েছি। দলের কর্মীদের মধ্যে, সাধারণ সমর্থকদের মধ্যে জোট নিয়ে অভূতপূর্ব উন্মাদনা তৈরি হল। একই রকম সাড়া পাওয়া গেল বামেদের দিক থেকেও। সমর্থকদের এই স্বতঃস্ফূর্ততাতেই বাংলায় বাম এবং কংগ্রেসের কাছাকাছি আসার পথটা আরও মসৃণ হয়ে গেল।
অস্বীকার করে লাভ নেই, পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিএমের সম্পর্ক বছরের পর বছর ধরে বেশ খারাপ ছিল। দু’পক্ষে হানাহানি কম হয়নি। কিন্তু তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর থেকে রাজ্যে যা শুরু হল, তা সব অত্যাচারের ইতিহাসকে ছাপিয়ে গিয়েছে। কংগ্রেসের সমর্থন এবং কংগ্রেসের অকুণ্ঠ সহায়তায় ভর করে ক্ষমতায় এলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ক্ষমতায় এসেই তাঁর এবং তাঁর দলের প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠল, কংগ্রেসকে শেষ করে দেওয়া। ভয় দেখিয়ে, হুমকি দিয়ে, পুলিশ রাজ কায়েম করে কংগ্রেস ভাঙাতে শুরু করল তৃণমূল। একই অবস্থার শিকার হল সিপিএমও। রাজ্য থেকে বিরোধী দলের সমস্ত চিহ্ন মুছে দেওয়ার চেষ্টা শুরু হল। এই পরিস্থিতিতেই কাছে আসতে পেরেছে কংগ্রেস-বাম। এবং এই সমঝোতার প্রতি বা এই জোটের প্রতি গোটা রাজ্যে একটা সমর্থনের প্লাবন দেখতে পাচ্ছি। যখন বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছিল, কংগ্রেস আর বাম হল তেল আর জল, কোনও দিন মিশবে না, জোর করে জোট হচ্ছে, তখন মাঝে মাঝে নিজেরাও ধন্দে পড়ে যাচ্ছিলাম। কর্মী-সমর্থকরা কী ভাবছেন? তাঁরা খুশি তো? বার বার এই প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছিল মনে। কিন্তু কংগ্রেস এবং বাম দলগুলির কর্মী-সমর্থকরা বুঝিয়ে দিলেন, তাঁরা এটাই চাইছিলেন। তাঁদের মধ্যে শুধু খুশি নয়, খুশির প্লাবন এসেছে। তৃণমূলের অসহিষ্ণু রাজনীতির বিরুদ্ধে, বিরোধী মতকে পিষে মারার রাজনীতির বিরুদ্ধে, গণতন্ত্রকে শেষ করে দেওয়ার রাজনীতির বিরুদ্ধে এই প্লাবন। যে ভাবে গোটা রাজ্যে কংগ্রেসের পতাকা আর সিপিএমের পতাকা নিয়ে হইহই করে যৌথ ভাবে পথে নামতে শুরু করেছেন মানুষ, তা দেখে আমি নিজেই এখন বিস্মিত।
বাম-কংগ্রেস জোট নিয়ে যাঁরা এখনও চোখ কপালে তুলছেন, তাঁদের উদ্দেশ্যে বলি, পশ্চিমবঙ্গে জোট রাজনীতি কোনও নতুন বিষয় নয়। বাংলা এমন একটা রাজ্য, যেখান থেকে দশকের পর দশক ধরে জোট রাজনীতি চলছে। বিভিন্ন দলের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে জোট দেখেছে এই রাজ্য। কংগ্রেস গোড়া থেকে এই জোট রাজনীতিতে যেতে চায়নি। ভারতে তো নয়ই, পশ্চিমবঙ্গেও নয়। কিন্তু পরে কংগ্রেসকে সেই নীতি থেকে সরতে হয়। কারণ ভারতীয় গণতন্ত্রে জোট রাজনীতির যুগটা এসে গিয়েছিল। সময়ের দাবিকে অস্বীকার করে কোনও দল টিকে থাকতে পারে না। তাই কংগ্রেসও বিভিন্ন রাজ্যে জোট রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে শুরু করে। বাংলাও তার ব্যতিক্রম নয়। এ রাজ্যে তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেসের জোট যেমন হয়েছে, তেমন বামেদের সঙ্গেও হয়েছে। সিপিআই-কংগ্রেস আগেও হাত মিলিয়ে লড়েছে। অর্থাৎ এ রাজ্যে নির্বাচনী জোট গঠন করাও কংগ্রেসের কাছে নতুন নয়, বামপন্থী দলের সঙ্গে জোট বাঁধাও নতুন নয়। যাঁরা গেল গেল রব তুলছেন, তাঁরা কংগ্রেসেরও কেউ নন, বামেদেরও কেউ নন। বাম-কংগ্রেস জোট দেখে যাঁরা ভয় পেয়েছেন, হেরে যাওয়ার আভাস পাচ্ছেন, তাঁরাই গেল গেল রব তুলছেন।
পরিবর্তনের নাম করে তৃণমূল রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছিল। কিন্তু কোনও পরিবর্তন হয়নি। শিল্পের সর্বনাশ হয়েছে, কর্মসংস্থানের নামে শুধু ভাঁওতা দেওয়া হয়েছে, শিক্ষা ব্যবস্থার কোমর ভেঙে দিয়েছে। শুধু কিছু কসমেটিক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। কয়েকটা রাস্তায় ত্রিফলা বাতি লাগানো, কয়েকটা বাড়িতে বড় বড় গেট বসানো, কয়েকটা জায়গায় নীল-সাদা রং লাগানো— এই হল পরিবর্তন। এই কসমেটিক পরিবর্তনের ভাঁওতা রাজ্যের যুব সমাজ ধরে ফেলেছে। যাঁরা আশা করেছিলেন শিল্প হবে, কর্মসংস্থান হবে, প্রশাসন দুর্নীতিমুক্ত হবে, তাঁরা সাংঘাতিক হতাশ। কারণ গত পাঁচ বছরে রাজ্যে ঠিক উল্টোটাই ঘটেছে। ফলে জনমতের যে জোয়ারে ভেসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গদিতে পৌঁছেছিলেন, সেই জোয়ার এখন নেই। রাজ্যবাসী হতাশ। সরকারি চাকরিতে নিয়োগ প্রক্রিয়ার দুর্নীতি এবং কর্মসংস্থানের অভাব দেখে যুব সমাজ আরও হতাশ। সেই হতাশা থেকেই জনমতের জোয়ার এ বার জোটের দিকে।
তবে একটা পরিবর্তনের কথা আমি বলব। সিপিএমের মধ্যে আমি একটা ফলিত পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। অসহিষ্ণুতা, উন্নাসিকতার পরিবর্তে সিপিএমের মধ্যে একটা সহিষ্ণু ভাব দেখতে পাচ্ছি। ৩৪ বছর ক্ষমতায় থেকে যে অহঙ্কার বাসা বেঁধেছিল, তা আজ অতীত। সিপিএম বুঝেছে, অহঙ্কারই ডুবিয়ে দিয়েছিল। সেউ উপলব্ধিই সিপিএমের মধ্যে ফলিত পরিবর্তনটা এনেছে। আগে কংগ্রেসের নাম শুনলেই কেমন যেন এক লাফে দূরে সরে যেত সিপিএম। এখন তেমন নয়। কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতার প্রশ্নেও এই সিপিএম অনেক আন্তরিক। তাই এই সমঝোতাকে, এই জোটকে শুধু বাংলার জোট ভাববেন না। বাম-কংগ্রেসের এই সমঝোতা গোটা ভারতের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে চলেছে। গণতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষতার পথে ভারত থাকবে, না দূরে সরে যাবে সেই পথ থেকে, গোটা দেশের সামনে এখন সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন সেই প্রশ্নকে সামনে রেখেই হবে। কংগ্রেস আর বামেদের সে লড়াই হাত মিলিয়েই লড়তে হবে। বাংলা তার সূচনা করে দিচ্ছে।