সিংমারি পেরোতেই তাঁর পতাকায় মুখ ঢাকলো আকাশ

দার্জিলিঙে ভানুভবনের সামনে থেকে যখন গাড়িতে উঠলাম, ঘড়িতে সবে আটটা। সকালের প্রবল ঠান্ডায় হাত-পা জমে যাওয়ার উপক্রম। শুনলাম, এর মধ্যেই নাকি তাঁর ব্যাডমিন্টন খেলা এবং সকালের গা-ঘামানো শেষ। স্নানে ঢুকেছেন। কিছু ক্ষণের মধ্যে দর্শন দেবেন জনতাকে।

Advertisement

দেবাশিস চৌধুরী

দার্জিলিং শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০১৬ ১৬:০৪
Share:

দার্জিলিঙের সিংমারিতে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার দলীয় অফিস। ছবি: রবিন রাই।

দার্জিলিঙে ভানুভবনের সামনে থেকে যখন গাড়িতে উঠলাম, ঘড়িতে সবে আটটা। সকালের প্রবল ঠান্ডায় হাত-পা জমে যাওয়ার উপক্রম। শুনলাম, এর মধ্যেই নাকি তাঁর ব্যাডমিন্টন খেলা এবং সকালের গা-ঘামানো শেষ। স্নানে ঢুকেছেন। কিছু ক্ষণের মধ্যে দর্শন দেবেন জনতাকে।

Advertisement

সঙ্গী সাংবাদিক রেজা প্রধান ঘড়ি দেখছিলেন বারবার। ‘‘সময়মতো পৌঁছে যাব তো?’’ প্রশ্ন শুনে ঘাড় নাড়লেন। পাশে বসে চিত্র সাংবাদিক রবিন রাই হাত তুলে অভয় দিলেন, ‘‘চিন্তা কে কোই বাত নেহি হ্যায়, দাদা।’’

মার্চের দার্জিলিং হঠাৎ কেমন যেন কুয়াশা আর মেঘে মনমরা। সমতলে ছুটি পড়ে গিয়েছে। এ বার ছুট ছুট পাহাড়ের দিকে। সেই ভিড় ক্রমেই বাড়ছে শৈলশহরে। প্রতিদিনই ম্যালে দেখা মিলছে নতুন মুখের। বাংলা কথা শোনা যাচ্ছে আরও বেশি করে। কেভেন্টার্স থেকে নাথমুল্স, পথের পাশে সার দেওয়া দোকানে মাথা আরও ঘন হয়ে আসছে। সকালে যদি কেভেন্টার্সে এক কাপ কফির সঙ্গে চিকেন সালামি, তো বিকেলে কোনও টি-বারে ফার্স্ট ফ্লাশ। রঙিন শিশুরা ছুটে বেড়াচ্ছে ম্যালে। বাবা-মায়েরা অন্য দিকে গল্পে মশগুল। ভানু ভক্তের মূর্তির পিছনে বড় স্ক্রিনে চলছে ডিসকভারি চ্যানেল। শুধু মেঘের আড়ালে আপাতত মুখ লুকিয়েছেন কাঞ্চনজঙ্ঘা। সেটুকু বাদ দিলে হাওয়ায় কেবল ছুটির গন্ধ।

Advertisement

এই আবহে আরও একটি জিনিস অনুপস্থিত। সেটা হল বিধানসভা ভোট।

ভোট ঘোষণা হয়েছে সবে কয়েক দিন। ম্যালের কোথাও দাঁড়িয়ে তার রেশমাত্র চোখে পড়বে না। ম্যাল রোডের বাজারে জোরদার কেনাকাটার মধ্যে কোনও বাঙালি মুখ ফসকে যদি এই নিয়ে কোনও শব্দ বলেও ফেলছেন, তাঁর স্ত্রী চোখ পাকিয়ে বলছেন, ‘‘ও সব ভোট-পলিটিক্স রাখো তো! মায়ের জন্য এই শালটা নেওয়া যায় কি না, সেটা বলো।’’

অথচ এই আবহটাই এক পলকে বদলে যাচ্ছে সিংমারি থেকে। গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার দফতর এখানে। বিখ্যাত সেই হলুদ বাড়িটা ঘিরে হলুদ-সবুজ পতাকায় ছেয়ে গিয়েছে আকাশ। গোর্খাল্যান্ডের দাবি আর মোর্চার পতাকা— এই পাহাড় কিন্তু ভোটের উত্তাপে ফুটছে।

এবং আমার ভুল ধরিয়ে দিলেন সঙ্গী সাংবাদিকরাই। বললেন, আবহটা সম্বৎসর এমনই থাকে। পতাকায় তখনও মোড়া থাকে আকাশ। তবে ঘাড়ের উপরে ভোট নিঃশ্বাস ফেলছে বলে সংখ্যা কিছু বেড়েছে, সেটাও মেনে নিলেন।

দার্জিলিং ম্যালের আশপাশের রাস্তাঘাট এখন যথেষ্ট মোলায়েম। অথচ সিংমারি থেকে পাতলেবাস, মোর্চার অন্দরমহলের পথ বেশ খারাপ। রাস্তা সারাই চলছে, তেমন চিহ্ন কোথাও কোথাও দেখা গেল। তবে সে সামান্যই। কানের কাছে মুখ এনে এক সহযাত্রী বললেন, ‘এ দিকের পথ ঠিক হবে না। কেন, জানতে চাইবে না!’ কিছু দূর নামতে ডান হাতে পড়ল দুর্গের মতো তাঁর বাড়ি। আরও এক পাক নীচে পাতলেবাসের মোর্চা দফতর।

এখানেই দর্শন দেন তিনি, নিয়মিত। বাড়ির সামনে সরু পাহাড়ি রাস্তায় দাঁড়িয়ে বেশ কয়েক জন মানুষ। দু’তিন জন সাধুকেও দেখা গেল। এক সঙ্গী বলছিলেন, ‘‘পাতলেবাসেই তাঁর বরাবরের দফতর। যখন গোর্খা হিল কাউন্সিলে কাউন্সিলর ছিলেন, এখানে নিয়মিত বসতেন। এখনও সেই অভ্যাস বজায় রেখেছেন।’’ বাড়িটা নাকি ছোট ছিল। এখন আকারে বাড়ছে। তবে শুধু তলাগুলোর খাঁচাই হয়েছে। পাকাপাকি ঘর তৈরি হয়নি। রাস্তা থেকে সরু সিঁড়ি দিয়ে উঠে তেমনই একটা চাতালে গিয়ে দাঁড়ালাম।

সামনে সারিবদ্ধ ঘর। পরপর দরজা। সামনের দরজার উপরে লেখা ‘পাহাড় কি রানি’। বোধহয় নেপালিতে। তবে হিন্দিরই মতো। বেশ পড়তে পারলাম। চাতালে সার দিয়ে প্লাস্টিকের চেয়ার। সেখানে তত ক্ষণে বসে গিয়েছেন দর্শনার্থীরা। হাতের কাগজপত্র গুছিয়ে নিচ্ছেন, যাতে তিনি এলে সঙ্গে সঙ্গে ঠিকঠাক নথি এগিয়ে দেওয়া যায়।

পাশে কোনও বাড়িতে বোধহয় রান্না চড়ানো হচ্ছে। কাঠের জ্বালের গন্ধ ঢুকে পড়েছে হিম হাওয়ায়। বাড়ির সামনে রাস্তায় কলের জল পড়ছে। আশপাশের বাড়ির লোকজন এসে পাত্র ভর্তি করে নিয়ে যাচ্ছে। তার পর সেই জল গড়িয়ে প্রায় এক হয়ে যাওয়া রাস্তা আর নালা ভিজিয়ে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে কাদা।

আমার সামনের দরজাগুলোয় পুরনো ঝ্যালঝেলে পর্দা। এক পাশে পুরনো কাঠের আলমারি। বইগুলো অযত্নে পড়ে আছে। কিছু পড়ে আছে মাটিতেও। তার মধ্যে ইংরেজি পত্রিকা এবং বইও রয়েছে কয়েকটা। সবই পাহাড়, বিশেষ করে দার্জিলিং নিয়ে।

এমনই এক দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলেন তিনি। এই হিম সকালেও স্নান-টান শেষ করে একেবারে ফিটফাট। গায়ে গোলাপি ব্লেজার। কালো ট্রাউজার্স। চেয়ারে বসতেই পাশে আর একটি চেয়ারে কেউ এক জন রেখে গেলেন এক কাপ চা। দর্শনার্থীরা উঠে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানালেন। তার পর শুরু হল হরেক বিষয়ে আলোচনা। কারও দাবি, ম্যালের কাছে আস্তাবলের উপরে একটি কমিউনিটি হল বানানোর অনুমতি চাই। কারও আব্দার আবার অন্য কিছু নিয়ে।

তিনি শুনছেন হাসি মুখে। বোঝাচ্ছেন, কোনটা সম্ভব, কোনটা নয়। এর মধ্যেই চোখ গেল আমাদের দিকে। জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন। এক পার্ষদ এসে কানে কানে কিছু বলল। অপেক্ষা করতে বললেন চোখের ইশারায়।

অপেক্ষা করতে হল আরও মিনিট দশ। তার পরে এলো কথা বলার সুযোগ।

কী কথা তাঁর সঙ্গে? আলাপ পরিচয়ের পরে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কিছু যে আলোচনা হল, তা নয়। কী ভাবছেন ভোট নিয়ে, এ বার বিজেপি ছাড়াও কারও সঙ্গে সমঝোতা হচ্ছে কি না (তখনও পাহাড়ে প্রার্থী ঘোষণা হয়নি কোনও দলের। শিলিগুড়িতে জীবেশ সরকার সাংবাদিকদের ডেকে বলেননি, মোর্চাকে সমর্থন করছেন তাঁরা)— এই সব প্রশ্নের মুখে তাঁর জবাব একটাই, ‘‘এখনও কিছু ঠিক হয়নি। কথা চলছে।’’ তবে তৃণমূলকে যে হারাতে তিনি বদ্ধপরিকর, সেটা স্পষ্টই বলে দিলেন, ‘‘উসে হটানা হোগা।’’

বলে দিলেন, ‘‘দীপেনের (ওঁর সহযোগী) ফোন নম্বর নিয়ে নিন। কিছু জানতে হলে ওকে ফোন করতে পারেন।’’

আরও দর্শনার্থী তখনও লাইনে। আমরা উঠলাম। উনিও দাঁড়ালেন। প্রথমে হাত জোড় করে নমস্কার করেছিলেন। এ বার তেমন ভাবে বিদায় জানাতে গেলে হাত বাড়িয়ে দিলেন বিমল গুরুঙ্গ। হাড় হিম করা পাতলেবাসে উষ্ণ করমর্দন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন