প্রতিশ্রুতি বিস্তর, তবু অনুন্নয়নের আঁধারে কানু সান্যালের গ্রাম

১৫ বছরেরও বেশি আগের প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনায় তৈরি রাস্তার বিশেষ অবশিষ্ট নেই। দু’পাশে দু-একটি কাঁচা-পাকা বাড়ি। তার মাঝখানে ছোট্ট, প্রায় ৬০০ বর্গফুট এলাকা জুড়ে মাটির সাধারণ গৃহস্থ বাড়ি। মাটিলেপা এক চিলতে বারান্দা। তার উপরে ঘরে ঢোকার একমাত্র দরজাটায় নতুন তালা লাগানো।

Advertisement

সংগ্রাম সিংহ রায়

শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৬ ১৫:৩৫
Share:

ভেঙে পড়েছে সেতু।

১৫ বছরেরও বেশি আগের প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনায় তৈরি রাস্তার বিশেষ অবশিষ্ট নেই। দু’পাশে দু-একটি কাঁচা-পাকা বাড়ি। তার মাঝখানে ছোট্ট, প্রায় ৬০০ বর্গফুট এলাকা জুড়ে মাটির সাধারণ গৃহস্থ বাড়ি। মাটিলেপা এক চিলতে বারান্দা। তার উপরে ঘরে ঢোকার একমাত্র দরজাটায় নতুন তালা লাগানো। চেহারায় আর পাঁচটা বাড়ির মতোই। কিন্তু কাছে গেলে দেখা যাবে পতপত করে উড়ছে বাঁশের মাথায় টাঙানো লাল পতাকা। বারান্দার উপরে দেওয়ালে বাড়ির প্রাক্তন কর্তার নামে শ্রদ্ধার্ঘ লেখা পোস্টার। বাড়ির সীমানার সামনে দু’টি বাশের মাথায় লাগানো চাটাইয়ের তৈরি নোটিস বোর্ড। তাতে দলীয় নির্দেশ, ইস্তেহার, সাম্রাজ্যবাদী সরকারকে ফেলে দেওয়ার ডাক দিয়ে পোস্টার সাঁটানো। কারণ, বাড়িটি বর্তমানে সিপিআই(এমএল)-এর দলীয় কার্যালয়। বাড়ির প্রাক্তন কর্তার নাম কানু সান্যাল ও এলাকার নাম সেপদাল্লাজোত।

Advertisement

শিলিগুড়ি থেকে হাতিঘিসার দূরত্ব ২০ কিলোমিটার। বাগডোগরা থেকে ১০। এশিয়ান হাইওয়ের কাজ শুরু হওয়ায় রাস্তার দু’পাশের গত কয়েক বছর ধরে গড়ে ওঠা ঝুপড়ি দোকানগুলো ভেঙে দেওয়ায় রাস্তা থেকে সেপদাল্লায় ঢোকার রাস্তাটা চিনতে একটু কষ্ট হয়। জিজ্ঞাসা করে খুঁজে নিয়ে ঢুকতেই নজরে পড়ল সামনের দিকে বেশ কিছু নতুন বাড়িঘরে রং হয়েছে। হাইওয়ে ঘেঁষা রাস্তার একেবারে মুখে হাতিঘিসা অঞ্চল অফিস ঝকঝক করছে। কিন্তু তার পর থেকেই ভাঙা, এবড়োখেবড়ো রাস্তা দিয়ে সোজা আঁকাবাঁকা রাস্তা চলে গিয়েছে সেপদাল্লাজোতের ভিতরে। তারই মাঝে কয়েকটি বাঁক পেরিয়ে কানুবাবুর বাড়ি। মৃত্যুর ৬ বছর পরেও নাম বলতেই একবারেই চিনিয়ে দিলেন এক মহিলা। কানুবাবুকে শেষ দিন পর্যন্ত দেখাশোনা করেছেন যিনি সেই শান্তি মুণ্ডা এখনও চোখ বুজলে দেখতে পান, শান্ত সৌম্য মানুষটা মার্কস-লেনিন-মাও বোঝাচ্ছেন। তাঁর এক ডাকে ছুটে আসছে আশপাশের পাঁচটা গ্রামের ছেলে-জওয়ানরা। কিন্তু এত কিছুর পরেও গ্রামের কোনও উন্নতি হয়নি। তিনি থাকার সময়েও নয়, মারা যাওয়ার পরেও নয়। সব দলের লোকই এসেছেন এলাকায়, বিভিন্ন রকম প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু কাজ হয়নি। সিপিএমের ৩৪ বছরে নয়, তৃণমূলের পাঁচ বছরেও না। এমনকী, কেন্দ্রে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরে মডেল ভিলেজ হিসেবে হাতিঘিসাকে অধিগ্রহণ করার ঘোষণা করেছিলেন দার্জিলিংয়ের সাংসদ সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়া। ঘোষণা, সাংবাদিক বৈঠক, ভিআইপি মুভমেন্ট ছাড়া আর কিছু হয়নি বলে জানিয়ে দিলেন শান্তিুদেবী।

এলাকার বহু দিনের সমস্যা রাস্তা ও পানীয় জলের। রাস্তা সমস্যা কোনও দিনই মিটবে বলে আশা রাখেন না এলাকার রতন বর্মন, বিষ্ণু ওরাওঁরা। বর্ষা এলেই একহাঁটু কাদা। তার মধ্যে চার কিলোমিটার হেঁটে জাতীয় সড়কে পৌঁছতে হয় গ্রামের শেষ বাড়িটির বাসিন্দাকে। সেপদাল্লার পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে মাঞ্জা নদী। এই নদীর অন্য পাশে বীরসিংহজোত গ্রাম। তার মাঝে দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের দাবি মেনে পঞ্চায়েত থেকে সেতু বানানো হয়েছিল আট বছর আগে। পরে একটি ট্রাক্টরের ধাক্কায় সেতুর রেলিং ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গত বছর ভূমিকম্পের পরে রেলিংটি গোটাটাই পড়ে যায়। এলাকার তৃণমূলের পঞ্চায়েতকে বারবার বলা সত্ত্বেও কোনও পদক্ষেপ করেনি বলে আক্ষেপ সিন্টু মুণ্ডা, রতন মুর্মুদের।

Advertisement


প্রয়াত কানু সান্যালের বাড়ি।

পানীয় জলের সমস্যাও প্রকট। বছর ১০ আগে এলাকার ৫ হাজার পরিবারের জন্য দুটি জলের ছোট ট্যাঙ্ক বসানো হয়েছিল এলাকায়। তা বসানোর পর থেকে পরিষ্কার করা হয় না। তবু ওই জলই খেতে হচ্ছে এলাকার মানুষকে। জানা গেল, জল ভরে ফুটিয়ে খান তাঁরা। কারণ ট্যাঙ্কে সাপ, ব্যাং মরে থাকে। এ ছাড়া কুয়ো ও নলকূপের অপরিশ্রুত জলও খেতে বাধ্য হন অনেকে। আগে নদীর জলও খেতেন অনেকে। কিন্তু গত কয়েক বছরে নদীতে বাঁধের কাজ শুরু হলে জল নোংরাই থাকে সব সময়। তাই অন্য কাজ হলেও জল খাওয়ার জন্য নদীতে নামেন না কেউ। এলাকার মানুষের অধিকাংশের হাতেই কাজ নেই। ইদানীং জমির দাম বাড়ায়, অনেকেই জমি বিক্রি করে দিয়েছেন কিছু কাঁচা পয়সার লোভে। অর্থের অনভ্যাসে সে টাকাও তাঁদের বছরখানেকের ফুর্তিতে শেষ। ফলে কর্মহীন এখানকার কয়েক হাজার যুবক। অনেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে নাম লিখিয়েছেন। তাতেও সমস্যা মেটেনি। একশো দিনের কাজ বছরে ১৫ দিনের বেশি পান না বলে জানা গেল। গ্রামের মানুষ বলছেন, কাজই নেই তো একশো দিন কাজ কী ভাবে হবে?

এর মাঝেই রাত পোহালে আর একটা বিধানসভা ভোট চলে এসেছে। জোট বা তৃণমূলের মধ্যে ক্ষমতায় যে-ই আসুক নতুন সরকার যে সমস্যা মেটাবে সে দুরাশা নেই মনে। এর পরেও ভোট দিতে তাঁরা বদ্ধপরিকর। নেওয়ালাল মুণ্ডা জানালেন, ভোট না দিলে তাঁরা যে দেশের নাগরিক তা সরকার বুঝবে কী করে? তাই তাঁরা ভোট দেন। এ বারেও ভোট দেবেন। দেবেন কোনও আশা না রেখেই।

ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন