বাসি মুখে বিয়ের কনের ভোট দিতে আসা ভুলব না

কয়েক ঘণ্টা ট্রেনে-বাসে জার্নির ধকল। রাত জাগার ক্লান্তি নিয়ে নির্বিঘ্নে বাড়ি পৌঁছনোয় মানসিক চাপ যেন এক লহমায় আমার শরীর থেকে বিদায় নিল।

Advertisement

নারায়ণ বিশ্বাস (প্রিসাইডিং অফিসার)

শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০১৬ ০১:৩৫
Share:

কয়েক ঘণ্টা ট্রেনে-বাসে জার্নির ধকল। রাত জাগার ক্লান্তি নিয়ে নির্বিঘ্নে বাড়ি পৌঁছনোয় মানসিক চাপ যেন এক লহমায় আমার শরীর থেকে বিদায় নিল।

Advertisement

অনেক ভোট করানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে আমার। কিন্তু এ বার ভোট করানোর অভিজ্ঞতাটা একেবারে অন্য রকম। ভোটের এমন একটা দুর্লভ দৃশ্য আগে কখনও চোখে পড়েনি।

লাল বেনারসী, মাথায় মুকুট আর এক রাতের বাসি মালা গলায় ভোটকেন্দ্রে স্বয়ং কনে। নিজের ভোট নিজে দিয়ে শ্বশুরবাড়ি গেলেন তরুণীটি। ভোট দিয়ে বেরিয়ে মুখে তাঁর মিষ্টি হাসি ধরা পড়ল। পাশে ধুতি-পাঞ্জাবিতে বর। মনে মনে ভাব‌লাম, ‘এই তো সার্থক গণতন্ত্র’। এক জন ভোটকর্মী এবং গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল নাগরিক হিসেবে দৃশ্যটা আমি কোনও দিন ভুলব না।

Advertisement

আমি গুপ্তিপাড়ার বৈদিকপাড়ায় থাকি। গঙ্গাঘেঁষা কৃষ্ণবাটি চর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভৌতবিজ্ঞান পড়াই। এ বার আমার দায়িত্ব পড়েছি‌ল পুরশুড়া বিধানসভার কোটালপাড়ায় হরিদাসপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। একটি স্কুলে ৩টি আলাদা বুথ। তারই একটিতে প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব ছিল আমার কাঁধে।

গুপ্তিপাড়া থেকে পুড়শুড়া রুটটা বেশ বেঢপ। সরাসরি পৌঁছনোর ট্রেন বা বাস কিছুই নেই। ভোটের আগের দিন (২৯ এপ্রিল) সকাল পৌনে ৮টায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্রেন ধরে গেলাম শেওড়াফুলি। সেখা‌ন থেকে তারকেশ্বর লোকাল। সেখান থেকে দামোদরের সেতু টপকেই ডানহাতে ভোট সামগ্রী সরবরাহ করার কেন্দ্রে পৌঁছলাম বেলা সাড়ে ১১টায়। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত তেমন ছিল না। বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া রুটি-তরকারিতেই পেট ভরালাম। সব কিছু বুঝে নিয়ে ভোটকেন্দ্রে পৌঁছনোর বাস ছাড়তে বিকেল হয়ে গেল। একটা বাসে প্রায় ২৫ জন। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর রান্না করা ডিমের ঝোল-ভাতে নৈশাহার হল।

তার পরে ঘুমানোর পালা। আর এখানেই বিপত্তি। ঘুমানোর সরঞ্জাম বলতে একটা মশা মারার ধূপ। ব্যস! ছাপোষা মানুষের পক্ষে যে ঘুমানোর এমন ব্যবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া কী কঠিন, ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন! বাড়ি থেকে একটা চাদর নিয়ে গিয়েছিলাম। সেটাই পাতিয়ে নিলাম। প্যান্ট-জামা ভাঁজ করে মাথার নীচে গুঁজে বালিশ করলাম। আমার পাশে অন্য ভোটকর্মীরাও তাই করলেন। অচেনা জায়গা। তার উপর যতই কয়েল থাক, দু’একটা বেয়াড়া মশা কানের কাছে গান শোনাতে ভোলেনি। আসি আসি করেও বেচারা ঘুম আর এল না। কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা পালা করে দু’জন বুথ পাহারা দিয়ে গিয়েছেন। সারা রাত।

রাতেই দেখে নিয়েছিলাম আমাদের সকলের জন্য বরাদ্দ একটিমাত্র নলকূপ। তা-ও হাতল টিপে জল বের করতে প্রাণ বেরিয়ে যাবে। হাতলে প্রচণ্ড জোরে চাপ দিলেও জল বেরোতে চায় না যেন! এ সবের মধ্যেই সকাল ৬টার মধ্যে সব কিছু রেডি করতে হবে। তাই রাত থাকতেই উঠে পড়লাম। ঘড়িতে সাড়ে ৩টে। কলের হাতলে ঘটাং ঘটাং শব্দে আস্তে আস্তে অন্যরাও উঠে পড়লেন।

ঠিক সময়ে রেডি করে নিলাম সব কিছু। সকাল সওয়া ৬টা নাগাদ মক-পোল শুরু হল। ভোট শুরু হয় সকাল‌ ৭টা-তেই। আমার বুথে ৬০৫ জন ভোটার। তার মধ্যে ৫৩৯ জন ভোট দিয়েছেন। দুপুর ১২টার মধ্যেই ৪০০-এর বেশি ভোট পড়ে গিয়েছিল। তার পর থেকে অনেকটা সময় মাছি তাড়াতে হয়েছে!

ভোটার না থাকায় একটু বাইরে এসেছিলাম। তখনই সেই দুর্লভ দৃশ্য! শ্বশুরবাড়ি রওনা হওয়ার আগে বরের হাত ধরে ভোটকেন্দ্রে নববধূ। রাতে বুথের পিছনেই একটা প্যান্ডেলে আলো জ্বলছিল। শুনলাম, এই মেয়েটিরই বিয়ে হচ্ছিল। পাশের বুথ থেকে আঙুলে কালি লাগিয়ে তাঁকে আসতে দেখে সত্যিই খুশিতে মনটা ভরে গেল। মনে হল এই ঘটনার সাক্ষী অন্যদেরও করতে হবে। তাই মোবাইলে মেয়েটির ছবি তুলে রাখলাম।

ভোট শেষ হতে বাক্স-প্যাটরা গুছিয়ে প্রশাসনের কাছে জমা দিতে হবে। জমা দেওয়ার কেন্দ্রে পৌঁছতে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা হয়ে গেল। এ বার কী করে বাড়ি পৌঁছব— তা ভেবে বুকটা দুরুদুরু করছিল। একেবারে প্রথমে বলাগড় কেন্দ্রে ভোট করিয়েছি। তার পরে পাশের কেন্দ্রে। আর এখন এত দূরে পাঠায় যে সব কিছু শেষ করে বাড়ি ফেরাটাই কঠিন হয়ে যায়। সেটা নিয়ে কেউ ভাবে কি না, কে জানে?

এ বারেও আর একটু হলেই ফ্যাসাদ হচ্ছিল। ভোটের সরঞ্জাম দিয়ে আবিষ্কার করলাম, বাস কখন পাব ঠিক নেই। মুশকিল আসান হয়ে দাঁড়ালেন এক পোলিং অফিসার। আমার গোমড়া মুখখানা দেখে নিজের মোটরবাইকে চাপিয়ে তারকেশ্বর স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে গেলেন। কপাল ভাল ছিল। ৮টা ৫৫ মিনিটের ডাউন হাওড়া লোকালটা পেয়ে গেলাম। ৯টা ৪৭ মিনিটে ট্রেন শেওড়াফুলিতে ঢুকল। মিনিট কয়েকের মধ্যে ডাউন মালদহ পেয়ে গেলাম। কাটোয়ার দিকে যাওয়ার রাতের শেষ ট্রেন এটাই। বাড়ি পৌঁছলাম পৌনে ১২টায়। অভিযান শেষে শরীরটা এলিয়ে দিলাম বিছানায়।

ভদ্রলোক মোটরবাইকে করে স্টেশনে পৌঁছে না দিলে নির্ঘাত রাতটা পথেই কাটাতে হতো।

অনুলিখন: প্রকাশ পাল

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন