মেলার টাকা চেয়ে বিতর্কে গদাধর

সরকারি মেলা-উৎসবে খয়রাতির জেরে ধাক্কা খাচ্ছে বিভিন্ন উন্নয়নের কাজ। পাঁচ বছরের তৃণমূলের জমানায় এমন অভিযোগ নতুন নয়। ভাঁড়ারে টান থাকলেও ওই সব কর্মকাণ্ডের জন্য নিয়মিত ভাবে টাকা জুগিয়ে যেতে হয়েছে বিভিন্ন দফতরকে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নানুর শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০১৬ ০৩:১৮
Share:

এই সেই চিঠি। শুক্রবার নানুরে তোলা নিজস্ব চিত্র।

সরকারি মেলা-উৎসবে খয়রাতির জেরে ধাক্কা খাচ্ছে বিভিন্ন উন্নয়নের কাজ। পাঁচ বছরের তৃণমূলের জমানায় এমন অভিযোগ নতুন নয়। ভাঁড়ারে টান থাকলেও ওই সব কর্মকাণ্ডের জন্য নিয়মিত ভাবে টাকা জুগিয়ে যেতে হয়েছে বিভিন্ন দফতরকে।

Advertisement

এ বার একটি গ্রামীণ মেলার জন্য এলাকার পঞ্চায়েতগুলিকে অঙ্ক ঠিক করে দিয়ে টাকা দেওয়ার নির্দেশ জারি করে নতুন বিতর্কের জন্ম দিলেন নানুরের বিদায়ী তৃণমূল গদাধর হাজরা। শাসকদলের দাপুটে নেতার কাছ থেকে এমন ফরমান পেয়ে রীতিমতো তটস্থ পঞ্চায়েতগুলির প্রধানেরা। একলপ্তে এত টাকা আসবে কোথা থেকে, তা নিয়ে ঘোর দুশ্চিন্তায় নুন আনতে পান্তা ফুরনোর হাল হওয়া ওই পঞ্চায়েতগুলি। এই ঘটনাকে নির্বাচনী বিধিভঙ্গ রূপেই দেখছেন বিরোধীরা। ইতিমধ্যেই নির্বাচন কমিশনের দ্বারস্থ হয়েছে সিপিএম। যদিও এমন কোনও চিঠির কথা মনে করতে পারেননি এ বারও নানুরে তৃণমূলের প্রার্থী গদাধর।

প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রের খবর, অন্যান্য বছরের মতো এ বারও চণ্ডীদাস স্মরণোৎসব কমিটি ও গ্রামীণ মেলার পক্ষ থেকে নানুরে আগামী ২২-২৬ মার্চ চণ্ডীদাস মেলার আয়োজন করা হয়েছে। গদাধর ওই বেসরকারি আয়োজক সংস্থারই সহ-সভাপতি। সম্প্রতি ই-মেলে এলাকার ১১টি পঞ্চায়েতে তাঁর সই করা একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। ওই চিঠিতেই আগামী ২০ মার্চের মধ্যে মেলা পরিচালনার ব্যয় বাবদ চণ্ডীদাস–নানুর পঞ্চায়েতকে ৫০ হাজার এবং বাকি ১০টি পঞ্চায়েতকে ২০ হাজার টাকা জমা দিতে বলা হয়েছে। গত বছরের মতোই এ বারও মেলার বাজেট ধরা হয়েছে প্রায় ৫ লক্ষ টাকা। গোটাটাই আসে বিভিন্ন স্থানীয় সংস্থার থেকে সাহায্য বাবদ।

Advertisement

এ দিকে, ওই চিঠি পাওয়ার পরেই চাপে পড়ে গিয়েছে পঞ্চায়েতগুলি। সাধারণত মেলা, খেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পঞ্চায়েতের নিজস্ব তহবিল থেকে ওই ধরণের সাহায্য দেওয়া হয়। কর আদায়, বাড়ির অনুমোদন, টেন্ডার ফর্ম বিক্রি, বাড়ি কিংবা দোকানঘর ভাড়ার মতো কিছু সীমিত আয়ের উৎস থেকেই পঞ্চায়েতগুলি নিজস্ব তহবিল গড়ে। অধিকাংশ পঞ্চায়েতেই ওই তহবিল বাবদ বছরে আড়াই থেকে তিন লক্ষ টাকা সংগৃহীত হয়। সেই তহবিল থেকেই সারা বছরের টেলিফোন, বিদ্যুৎ বিল, মিটিংয়ের চা-টিফিনের খরচ, নলকূপ মেরামতি-সহ বিভিন্ন ধরণের খরচ চালাতে হয়। তাই এমনিতেই ওই টাকায় সব দিক চালাতে পঞ্চায়েতের নাভিশ্বাস ওঠে। তার উপরে আর্থিক বছর শেষের মাসে ওই তহবিলের টাকা তলানিতে এসে ঠেকেছে। এই পরিস্থিতিতে গদাধরের চিঠি পেয়ে চরম চাপে পড়েছে বেশির ভাগ পঞ্চায়েতই। জলুন্দি পঞ্চায়েতের প্রধান তপনকুমার ঘোষ, চারকলগ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান মমতাজ বেগমরা বলছেন, ‘‘এমনিতেই নিজস্ব তহবিলের অবস্থা খারাপ। এই অবস্থায় ওই পরিমাণ টাকা দিতে হলে আর পঞ্চায়েত চালানো যাবে না। কী করব ভেবে পাচ্ছি না।’’

ঘটনা হল, সরকারি না হলেও নানুরের ওই গ্রামীণ মেলার সঙ্গে স্থানীয় স্বায়ত্ত শাসিত সংস্থাগুলির সম্পর্ক দীর্ঘ দিনের। মহকুমাশাসক ওই আয়োজক কমিটির সভাপতি। আবার কোষাধ্যক্ষ ব্লকের এক জন কর্মী। প্রশাসন সূত্রেই খবর, গত বছর মেলার বাজেটের পাঁচ লক্ষের মধ্যে পঞ্চায়েত সমিতি ২ লক্ষ, ঠিকাদার সমিতি ৬৫ হাজার, চণ্ডীদাস-নানুর পঞ্চায়েত ৩৫ হাজার এবং বাকি দশটি পঞ্চায়েত ২০ হাজার টাকা করে দিয়েছিল। অতীতে জেলা পরিষদও ওই মেলার আয়োজনে আর্থিক সাহায্য দিয়েছে বলে জানিয়েছেন নানুরের বিডিও মৃণালকান্তি বিশ্বাসও। গত বছর মেলার কোষাধ্যক্ষ ছিলেন ব্লকের ত্রাণ দফতরের এক আপার ডিভিশন ক্লার্ক। এ বার কোষাধ্যক্ষ ব্লক হর্টিকালচারের চুক্তি ভিত্তিক কর্মী মানস গড়াই। এ দিন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সাংবাদিক পরিচয় পেতেই তিনি ফোন কেটে দেন। পরে করলেও আর ধরেননি।

গত বারই মেলায় আর্থিক সাহায্য করলেও এ বার আপত্তি কেন? তপনবাবুরা দাবি করছেন, নিজস্ব তহবিলের অবস্থা খারাপ হওয়ার কারণেই মেলায় টাকা দিতে ঘোর সমস্যায় পড়েছেন তাঁরা। মুখে এমনটা দাবি করলেও এই আপত্তির নেপথ্যে উঠে আসছে নানুরে শাসকদলের দীর্ঘ দিনের গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের কথাই। যে দ্বন্দ্বের মাথায় রয়েছেন নানুরের দাপুটে তৃণমূল নেতা কাজল শেখ এবং দলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল ঘনিষ্ঠ গদাধর হাজরা। তৃণমূল সূত্রের খবর, খাতায় কলমে না হলেও গত বছরও ওই মেলার অন্যতম হর্তাকর্তা ছিলেন কাজল। এ বছর তাঁকে বাদ রেখেই মেলার আয়োজনে নেমেছেন গদাধরেরা। আর তাতেই চটেছেন কাজল। এলাকায় কাজল ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত এক তৃণমূল নেতার কথায়, ‘‘দাদাকে উপেক্ষা করে এই এলাকায় কোনও কাজ করা যাবে না। সেই বার্তা পৌঁছে দিতেই দাদার নিয়ন্ত্রণে থাকা পঞ্চায়েতগুলি থেকে টাকা দিতে আপত্তি এসেছে।’’ বিষয়টি নিয়ে কাজল কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে ১১টি পঞ্চায়েতের একটা বড় অংশেই কাজল গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে তৃণমূল সূত্রের খবর।

এ দিন চিঠির খবর ছড়িয়ে পড়তেই সমালোচনায় সরব হয়েছেন বিরোধীরা। সিপিএমের জেলা সম্পাদক মনসা হাঁসদার অভিযোগ, মেলার নামে টাকা তুলে ভোটের কাজে লাগানোর জন্যই ওই চিঠি পাঠানো হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘‘এক জন প্রার্থীর ওই ভাবে পঞ্চায়েতে পঞ্চায়েতে চিঠি পাঠিয়ে টাকা তোলার এক্তিয়ার আছে কিনা, তা নির্বাচন কমিশনের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে। আমরা নানুরের বিডিও-কে বিষয়টি জানিয়েছি।’’ গদাধর অবশ্য ওই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁর দাবি, ‘‘আমি ওই কমিটির সহ-সভাপতি মাত্র। এমন কোনও চিঠি পাঠানো হয়েছে কিনা খোঁজ না নিয়ে বলতে পারব না। বোলপুরের এসডিও কমিটির সভাপতি। তার কাছেই খোঁজ নিন।’’ যোগাযোগ করা হলে মিটিংয়ে ব্যস্ত আছি জানিয়ে ফোন রেখে দেন এসডিও শম্পা হাজরা।

তবে বিডিও জানিয়েছেন, সরকারি মেলা না হলেও এলাকাবাসীর আবেগের কথা মাথায় রেখে দীর্ঘ দিন ধরে নানুর পঞ্চায়েত সমিতি নৈতিক ভাবে চণ্ডীদাস স্মরণোৎসবের পাশে থেকে এসেছে। সাধারণ ক্ষেত্রে আর্থিক নিয়ম খতিয়ে দেখে জেনারেল বডিতে রেজোলিউশন করে পঞ্চায়েতও কোনও মেলাকে তার নিজস্ব তহবিল থেকে সাহায্য করতে পারে। ‘‘কিন্তু, বর্তমানে বিধানসভা ভোটের কারণে নির্বাচনী বিধি জারি রয়েছে। এই অবস্থায় কোনও সরকারি অফিসার ওই মেলার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন না। একই কারণে পঞ্চায়েতগুলিকেও মেলার জন্য টাকা দিতে বারণ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে মেলা কমিটিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অনুমতি নিতেও বলা হয়েছে’’—বলছেন মৃণালবাবু।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন