এই সেই টিউবওয়েল। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।
এ যেন হাতে না মেরে জলে মারা!
টিউবওয়েল আছে, অথচ জল নেই। একটু ভুল বলা হল! জল আছে, তবে, টিউবওয়েলে তালা লাগানো। শুধু কি তালা লাগানো? দুনিয়ার কাঁটা-ঝোপ এনে কলতলা ঢেকে দেওয়া হয়েছে। টিউবওয়েলের মূল অংশের সঙ্গে মোটা একটা শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে তার হ্যান্ডল। আর তার গায়ে লাগানো একটা বড় তালা। এবং একটি পতাকা! শাসক দলের! তৃণমূলকে ভোট না দেওয়ার অভিযোগ তুলে, তাঁদের পানীয় জল বন্ধ করে দিতেই এমনটা করা হয়েছে বলে গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন।
ভোটের তাপ অনেকটাই কমেছে। কিন্তু, চৈত্রের চাঁদিফাটা রোদের হাত থেকে নিস্তার নেই জঙ্গমহলের। বুধবার সেই তাপমাত্রা ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের দরজা ছুঁয়েছে। গ্রামের সব পাতকুয়োয় জল শুকিয়ে গিয়েছে। তলার দিকে চিক চিক করে দেখা যায় জলের রেখা। যদিও সে জল উপরে তোলা দুঃসাধ্য। সে কারণেই গরমকালে গ্রামের লোকের ভরসা ছিল বছরখানেক আগে বসানো একটি টিউবওয়েল। কিন্তু, রাজ্যে বিধানসভা ভোটের প্রথম পর্যায়ে গোপীবল্লভপুর বিধানসভার ওই গ্রামের বাসিন্দাদের বেশির ভাগই নাকি শাসকদল তৃণমূলকে ভোট দেননি। গত সোমবার তাঁরা নাকি সিপিএম এবং বিজেপিকেই ভোট দিয়েছেন। এই অভিযোগে, গ্রামের সেই টিউবওয়েলটি তালাবন্ধ করে দেওয়া হল!
ঝাড়গ্রাম ব্লকের লোধাশুলি গ্রাম পঞ্চায়েতের ডালকাটি গ্রাম। ওই গ্রামের বুক চিরে চলে গিয়েছে গজাশিমূল থেকে রোহিনী যাওয়ার রাস্তা। তারই এক পাশে লোধাপাড়া আর অন্য পাশে মাহাতো পাড়া। সেখানে সব মিলিয়ে প্রায় ৭০টি পরিবারের বাস। আর তাঁদের পানীয় জলের ব্যবস্থা করতেই সরকার থেকে বছরখানেক আগে বসানো হয়েছিল ওই টিউবওয়েলটি। এলাকার প্রায় সাড়ে ৩০০ মানুষ পানীয় জলের জন্য ওই টিউবওয়েলের উপরই নির্ভর করতেন।কিন্তু, মঙ্গলবার সকালে কে বা কারা তাতে তালা লাগিয়ে গিয়েছে। এলাকার পাতকুয়োগুলোয় জলস্তর নেমে যাওয়ায় ব্যপক জলকষ্টের মধ্যে পড়েছেন তাঁরা। কয়েক কিলোমিটার দূরের অন্য গ্রাম থেকে জল নিয়ে আসতে হচ্ছে।
এ দিন সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, শিকল এবং তালা লাগানো অবস্থায় পড়ে রয়েছে টিউবওয়েলটি। পাশেই জিতেন মাহাতোর তেলেভাজার দোকান। পানের সরঞ্জামও রয়েছে সেখানে। সকাল থেকেই আলুর চপ, বেগুনি, ফুলুরির মেলা বসেছে। কারা বন্ধ করে দিল টিউবওয়েল? ‘‘কে যে লাগাল, ঠিক বুঝতে পারছি না জানেন! কাল সকালেই লাগিয়েছে।’’—বললেন মধ্যবয়সী জিতেনবাবু। সকাল তখন কত হবে? জবাব এল, ‘‘এই ধরুন ৭টা হবে।’’ তখন তো ভরা দিনের আলো! তাও দেখতে পেলেন না? আমতা আমতা করতে থাকেন জিতেনবাবু। নিজের রাজনৈতিক পরিচয়ও দিলেন। সক্রিয় দল করেন না, তবে তৃণমূলকে সমর্থন করেন। তিনি যখন আমতা আমতা করছেন এ সব নিয়ে, তখন পাশ থেকে সরব হলেন গ্রামের কয়েক জন মহিলা। বললেন, ‘‘পরিষ্কার করে বলো না কেন, ওরা আমাদের তৃষ্ণার জল কেড়ে নিয়েছে।’’ চুপ করে গেলেন জিতেনবাবু।
লোধা এবং মাহাতো পাড়ার বাসিন্দারা জানালেন, সোমবার এলাকায় ভোট ছিল। তার পর দিন সকালে এক দল লোক এসে শিকল দিয়ে টিউবওয়েল বেঁধে দেয়। তৃণমূলের পতাকা লাগিয়ে দিয়ে বলে, ‘‘তোদের আর জল খেতে হবে না। সিপিএম-বিজেপিকে ভোট দিয়েছিস। তারাই এখন জলের ব্যবস্থা করে দিক। সরকার আর জল দেবে না।’’ স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য সবিতা মল্লিক বললেন, ‘‘এরা যে কী শুরু করেছে! গরম বেড়ে গিয়েছে। পাতকুয়োগুলোর জলস্তর নেমে গিয়েছে। গ্রামের লোকেরা তেষ্টা মেটাবে কী দিয়ে ভেবে পাচ্ছি না!’’
এই ঘটনার প্রতিবাদে মুখ খুলেছেন গ্রামের বাসিন্দারা। যেমন পুষ্পরানি মাহাতো বলেন, ‘‘জল নিয়ে রাজনীতি করা ঠিক না। আমরা তো সক্রিয় রাজনীতি করি না।’’ আবার কল্পনা মাহাতো বললেন, ‘‘আমার বৌমার বাচ্চা হয়েছে। কাল ২১ দিনের খাওয়াদাওয়ার ভোজ। অথচ জলই পাচ্ছি না। আমরা খুব সমস্যার মধ্যে পড়ে গিয়েছি।’’ ঘটনার পর ২৪ ঘণ্টা কেটে গেলেও প্রশাসনকে জানানো হয়নি। কারণ? ভয়। জানাজানি হতে যদি ওরা আরও বড় কোনও ক্ষতি করে! ওরা তো সংখ্যায় কম নয়! যদিও সবিতা দেবী জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার তিনি প্রশাসনের কর্তাদের জানাবেন।
গ্রামবাসীদের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছে, তখনই সাইকেল নিয়ে সেখানে পৌঁছলেন এক যুবক। সবুজ গেঞ্জি, নীল রঙের ট্রাকস্যুট, কিটোর জুতো। ঘিুরে ফিরে আগন্তুকের দিকে তাকাচ্ছেন। যেন, মেপে নিচ্ছেন। আর তার পরেই দেখা গেল, খবর সংগ্রহ করতে আসা সাংবাদিকদের দিকে ধেয়ে আসছে জনা দশেক মানুষ। তাঁদের মধ্যে মহিলাও রয়েছেন। তাঁদের ‘ধর ধর, ছবি তুলে নিয়ে গেল’ রবের ভেতরেই শোনা গেল পুষ্পা-কল্পনারা বলছেন, ‘‘তোমরা পালাও, নইলে তোমাদের দিবে!’’