রোদ পড়তেই গ্রামের আলপথ ধরে এ ভাবেই ঢোকা শুরু হয় বা-বা, অর্থাৎ বাইকবাহিনীর।
সন্ধে নেমেছে তখন। কোচবিহারের এক গ্রামে বসে ভোট নিয়ে কথা হচ্ছিল সম্পন্ন চাষি মহম্মদ নূরউদ্দিনের সঙ্গে। একটা আওয়াজ পেয়ে আচমকাই লাফিয়ে উঠলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব কৃষক। ফিসফিস করে বলে উঠলেন, ‘‘চুপ করে দাওয়ায় বসে থাকুন। সাবধান! ‘বা-বা’ আসছে।’’ দ্রুত ঘরের বাইরে বেরিয়ে বেড়ায় টাঙানো দলের পতাকা খুলে লুকিয়ে ফেললেন নূরউদ্দিন।
নূরউদ্দিন একা নন, লাগোয়া বাড়িগুলি থেকেও কেউ না কেউ বেরিয়ে বিদ্যুৎগতিতে গুটিয়ে ফেললেন ফেস্টুন-পতাকা। খানিকক্ষণ পরেই বাইক নিয়ে হইহই করে মেঠো পথে ধূলোঝড় তুলে পাশের গ্রামের দিকে চলে যায় জনা ২০ ছেলেছোকরা। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন নূরউদ্দিন। বলেন, ‘‘এভাবেই বাইক বাহিনী ঘুরে বেড়ায়। আমরা বলি ‘-বা-বা’। কোনও প্রশ্ন করলে দাপুটে বাপ-দাদার মতো মেজাজ দেখায় যে!’’
নির্বাচন কমিশন বাইক মিছিল নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। খাতায়-কলমে তা কোথাও হচ্ছে না। কিন্তু, গ্রাম-শহরের ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতা বলছে, শুধু কোচবিহার নয়, উত্তর দিনাজপুরের হেমতাবাদ, কালিয়াগঞ্জ কিংবা দক্ষিণ দিনাজপুরের তপন, গঙ্গারামপুরেও ক্রমশ যেন জাঁকিয়ে বসছে ‘বা-বা’র আতঙ্ক। এমন কী, খাস শিলিগুড়ির লাগোয়া ডাবগ্রাম-ফুলবাড়িতেও ইতিউতি ‘বা-বা’র দাপট ক্রমশ বেড়ে চলছে।
উত্তর দিনাজপুরের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী গ্রামের সম্পন্ন চাষি ফকির আলির কথাই ধরা যাক। ২০ বিঘা জমির মালিক ফকির অর্ধেকটায় ধান চাষ করেন। বাকিটুকুতে ফলান শাক-সব্জি। ফকির বলেন, ‘‘ক’দিন আগে সকালে একটা দলের মিছিলে গাঁয়ের ক’জনে গিয়েছিলাম। দুপুর গড়াতেই গোটা বিশেক বাইক গ্রাম কাঁপিয়ে ঘুরে অকথ্য গালি দিয়ে শাসাল। ছেলের বয়সী সব ছেলে‘আমরা তোর বাপ’ বলে ধমকাল। সেই থেকে গাঁয়ের সকলে সিঁটিয়ে আছে। এখন ভটভট আওয়াজ শুনলেই বুক কাঁপে।’’
একই অভিযোগ আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়িতেও। কালচিনি থেকে শালকুমার, সাহেবপোতা, মাদরিহাট শামুকতলা এলাকায় কোথাও দিনের বেলায়, কোথাও রাত নামলেই ‘বা-বা’র দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ অনেকেই।
খাস শিলিগুড়ি পুরসভার সংযোজিত এলাকার কয়েকটি ওয়ার্ডেও বাইক বাহিনী সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত সুযোগ পেলেই এলাকা দাপিয়ে কর্তৃত্ব কায়েমের চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি ডাবগ্রাম-ফুলবাড়িতে এক দলের মিছিলের সময়ে আরেক দলের বাইক বাহিনী হুঁশিয়ারি দেওয়ায় তা থানা-পুলিশ পর্যন্ত গড়িয়েছে। চাপের মুখে পুলিশ মোটরবাইক-সহ ৪ জনকে গ্রেফতার করে। কিন্তু, সেদিনই জামিন পেয়ে যায় তারা। তাই রাতের ঘুম উবে গিয়েছে বাসিন্দাদের।
‘বা-বা’র আড়ালে কারা তা নিয়ে অবশ্য চাপানউতর তুঙ্গে।
তৃণমূল কংগ্রেসের জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ারের জেলা সভাপতি ও আলিপুরদুয়ার বিধানসভা কেন্দ্রের প্রার্থী সৌরভ চক্রবর্তীর অভিযোগ, ‘‘এ সব বাইক বাহিনী সিপিএম-কংগ্রেস জোটের। বিষয়টি নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছি। লাভ হচ্ছে না।’’ আলিপুরদুয়ারের সিপিএমের জেলা সম্পাদক কৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য দাবি করেছেন, তাঁরা মানুষের বাহিনীর উপরেই ভরসা করেন।
‘বা-বা’র ঘেরাটোপে জেরবার হচ্ছেন নেতারাও। নাটাবাড়ি বিধানসভা কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী তমসের আলির অভিযোগ, ‘‘ শুক্রবার রাতে বলরামপুরের ২৩৬ নম্বর বুথে বাইক বাহিনী তাণ্ডব চালায়। জোটের কর্মীদের মারধর করা হয়। শনিবার দিনের বেলা আমি বলরামপুরে পৌঁছলে আমাকে ঘিরেও চরকি পাক দিতে থাকে বাইক বাহিনী। নির্বাচন কমিশনের পর্যবেক্ষককে ফোন করলে সকলে পালায়। এভাবে অবাধে ভোট হতে পারে?’’
যা শোনার পরে একসময়ের বাম নেতা বর্তমানে তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক, দিনহাটা কেন্দ্রের প্রার্থী উদয়ন গুহ তাঁর পুরানো বড় শরিককেই দূষেছেন। উদয়নবাবু বলেন, “ভোটে বাইক বাহিনী ব্যবহার সিপিএম আমলে শুরু হয়েছে। বাহিনী তৈরি করে গ্রামে গ্রামে সন্ত্রাস হতো। মারধর করত। এখন বাহিনীর ব্যাপার নেই।’’
তা হলে কারা ঘুরছে? উদয়নবাবুর যুক্তি, ‘‘এখন বাইক গ্রাম-শহরের অন্যতম বাহন। মিটিঙে যোগ দিতে একটা বাইকে ২-৩ জন যায়। দল বেঁধে যায়। সেটাকে বাইক বাহিনী বলা ঠিক হবে না।”
রাহা-খরচ
‘বা-বা’র ছেলেদের কয়েকজনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গোড়ায় দলের সমর্থকদের কার-কার বাইক আছে তার তালিকা তৈরি হয়। বাইকের তেল বাবদ রোজ গড়ে ২০০ টাকা, টিফিন বাবদ মাথা পিছু ১০০ টাকা মেলে। চমকানো, ধমকানো, বিপক্ষের পতাকা, ফেস্টুন খোলার কাজ ‘ঠিকঠাক’ করতে পারলে দৈনিক মজুরি ৫০০ টাকা অবধি মিলতে পারে। ‘ভাল কাজ’ হলে রাতে ধাবায় খানাপিনার আসর। খরচ জোগাবেন সেই ‘দাদা’রা।
বাইকে পতাকা নয়
কমিশন বাইক মিছিল নিষিদ্ধ করতেই পতাকা উধাও। কোনও বাইকে পতাকা নেই। চট করে বোঝাও যাবে না কোন দলের হয়ে চমকাতে যাচ্ছে নাকি ঘুরে বেড়াচ্ছে। সুযোগ বুঝে বিপক্ষ শিবিরের সমর্থকের ঘরদোরের সামনের সব পতাকা খুলে নিতে হবে। সেখানে টাঙিয়ে দিতে হবে বাইকের ‘ডিকি’তে রাখা নিজের দলের পতাকা। তা খুলে ফেললে কী হবে তা জানিয়ে শাসানি দিয়ে চলে যাওয়া।
সত্যিটা আড়ালে
উত্তর দিনাজপুরের ইসলামপুরের যুযুধান শিবিরের দুই নেতার মনোনয়নের সময়েই দেখা গিয়েছে বিশাল ‘বা-বা’। দুজনে তা জানে না বলে দাবি করেছেন। চোপড়াতেও ‘বা-বা’র দাপট। নেতারা অস্বীকার করলেও পুলিশের হাতে আটক বা-বার ১০ সদস্য।
কিছুই জানে না কেউ
কখনও সুজাপুরের বিশাল বাইক বাহিনী গ্রাম কাঁপিয়ে দিচ্ছে। কখনও চাঁচলে। দাপিয়ে বেড়াচ্ছে রতুয়ায় পথেঘাটেও। কিন্তু, যাঁদের দলের হয়ে চলছে এমন দাপাদাপি, সেই দলের নেতাদের প্রশ্ন করলে আকাশ থেকে পড়েন তাঁরা। বলেন, ‘‘কোথায়? এমন হচ্ছে নাকি? আমাদের পতাকা লাগানো ছিল? তা না থাকলে সেটা বিরোধীদের। আমাদের বদনাম করতে চাইছে।
পুলিশের দাবি
‘বা-বা’র তাণ্ডব চলছে খবর পেলেই অভিযান হচ্ছে বলে দাবি করেছেন শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার মনোজ ভার্মা। দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে, ডাবগ্রাম-ফুলবাড়িতে শাসক দলের হয়ে বাইক-বাহিনী নিয়ে শাসানোর অভিযোগে গ্রেফতার ৪। রাজ্য পুলিশের উত্তরবঙ্গের একাধিক শীর্ষ অফিসারের দাবি, বাইক বাহিনীর অভিযোগ পেলেই তল্লাশি চালানো হচ্ছে।
এই তো সূযোগ
বাইক নিয়ে ঘোরা তো অপরাধ নয়। লাইসেন্স আছে। বাইকের কাগজপত্র ঠিক আছে। দলের পতাকা না থাকলেই হল। আমরা একসঙ্গে ১৫-২০টা বাইক নিয়ে আর ঢুকচি না। ৪-৫ টি বাইক নিয়ে ঘুরছি। আগে একজনকে পাঠিয়ে দেখে নিচ্ছি কমিশনের লোকজন আশেপাশে আছে কি না। তার পরে ঢুকছি। ভোটের কটা দিন একটু কামিয়ে নিচ্ছি। রোজ পার্টি হচ্ছে। একান্ত পুলিশে ধরলে দাদারা ঠিক সামলে নেবে।
কাজেই ‘বা-বা’কে রুখবে কে?