সোমেন মিত্র, নয়না বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রীতেশ তিওয়ারি
এ রকম তো বিসর্জনে দেখা যায়!
অনুব্রত মণ্ডলের ভাষা ধার করে বললে, চড়াম চড়াম করে ঢাক বাজছে! তাসা পার্টিও মজুত। বেলুন হাতে, রণ-পা চেপে কিছু চেহারা ভূতের মতো নড়াচড়া করছে। গোটাছয়েক দশাসই ট্যাবলো এগোচ্ছে। কোনওটায় চলমান মঞ্চে রবীন্দ্র নৃত্য, কোনওটায় লোক সংস্কৃতি, কোনওটায় লাইভ ব্যান্ড। ঝকমকে আলো, গমগমে আওয়াজে চোখ-কান ধাঁধিয়ে দিয়ে শহরের সান্ধ্য রাজপথ ধরে চলেছে বিশাল শোভাযাত্রা।
ট্যাবলো আর পদাতিক বাহিনীর মাঝে হুডখোলা জিপে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন, হেসে নমস্কার বিলোচ্ছেন, তাঁকেও দেখতে অনেকটা ঠাকুরের মতোই লাগছে! পাটভাঙা শাড়ি, ট্রে়ডমার্ক ফুলহাতা ব্লাউজ। ক্রমাগত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জমা হওয়া ব্যথা উপশমের জন্য সঙ্গে পেনকিলার স্প্রে-ও। পোর্টেবল লাইট হাতে অন্তত দু’জন আছেন আশেপাশে। ডান দিক, বাঁ দিকের বহুতলের গায়ে ক্রমাগত বুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে আলো। বারান্দায়, জানলায় একটা উৎসুক মুখও ধরা পড়লে যেন জিপ থেকে নমস্কার দিতে ফাঁকি না পড়ে!
কী করেছেন এ সব? নারদা, সারদার সব কালি এই আলো-গান-বাজনায় ঢেকে দেবেন নাকি? জিপে অবিরত নমস্কারের ফাঁকেই সলজ্জ হাসছেন নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘‘ধুর! এই একটাই এ রকম মিছিল করলাম। বাড়ি বাড়ি ঘুরছি তো। সারদা, নারদার স্টিং কিছু নয়। আসল স্টিং এই গরমটা! এর মধ্যে সকাল, বিকাল, রাত টানতে হচ্ছে!’’
টানছেন মানে দেখার মতোই টানছেন চৌরঙ্গির তৃণমূল বিধায়ক। শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে জনবসতি এলাকা হোক বা অফিস পাড়া— ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে সরকারের কাজের খতিয়ানে ভরিয়েছেন প্রার্থী। সঙ্গে অবশ্যই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ। এবং কিছুটা ঘরেলু পক্ষপাতিত্ব রেখেই হয়তো উত্তর কলকাতার সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি! নয়নার কথায়, ‘‘১৮ মাস আগে এখানে উপনির্বাচনে তত সময় পাইনি। এখন ১০টা ওয়ার্ডে কাজ হয়েছে, সাংসদ তাঁর এলাকায় কাজ করেছেন। তার ছাপ তো থাকবেই!’’
দর্শনধারীর ছাপ যে আগে পড়ে, সেই চেনা প্রবাদই ফের চৌরঙ্গিতে চেনাচ্ছেন সুদীপ-ঘরণী। লোকসভা ভোটে হাঙ্গামার বাজারেও এই কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থী সোমেন মিত্র যে হাজারদেড়েক ভোটে এগিয়ে ছিলেন, দর্শনধারীর চাপে এলাকায় মালুম হওয়া মুশকিল। শাসক দল হওয়ার অব্যর্থ সুবিধা নিয়ে দলে দঙ্গলে যুবক-যুবতীদের পথে নামিয়ে দেওয়া গিয়েছে। সেখানে কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিএমের জোটের গুণ বিচার তো পরের কথা!
নয়নার হয়ে নাচা-গানার লোক আছে। কংগ্রেস প্রার্থী সোমেনবাবুর সে সবের বালাই নেই। ধুতি-পাঞ্জাবি, ট্রেডমার্ক সাদা চটিতে তিনি আদ্যন্ত সিরিয়াস রাজনীতিক। তাঁর সঙ্গে বরং সুযোগ পেলে সঙ্গত করে যাচ্ছেন সন্তোষ পাঠক। কলকাতার ৪৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এবং উপনির্বাচনে নয়নার বিরুদ্ধে কংগ্রেস প্রার্থী সন্তোষ এ বার লড়তে গিয়েছেন উত্তর হাওড়ায়। তিনি চৌরঙ্গিতে না থাকায় তাঁর বাহিনী ভোটে খাটবে না বলে মৃদু একটা জল্পনা ছড়িয়েছিল। সন্তোষ তাই দায়িত্ব নিয়ে কর্মীদের বলছেন, ‘‘সোমেনদা’র বয়স হচ্ছে। তিনি না পারলেও সব বাড়িতে আপনারা যান।’’ আর মূলত হিন্দিভাষী জনতার উদ্দেশে আহ্বান জানাচ্ছেন, ‘‘আপনাদের রাগ থাকলে পরে আমার উপরে ফলাবেন! এখন ভোটটা ছোড়দা’কে দিন।’’
আর ‘ছোড়দা’? তাঁর কথায়, ‘‘মধ্য কলকাতা থেকেই রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছি। আমার রাজনৈতিক জীবন খোলা খাতার মতো। কখন কী করেছি, সবাই জানেন। সেইমতোই বিচার করবেন।’’ অধুনা অবলুপ্ত শিয়ালদহ কেন্দ্র থেকে ৭ বারের প্রাক্তন বিধায়কের অভিজ্ঞ চোখ আরও ধরতে পারছে, ‘‘সেই ১৯৭২ থেকে ভোটে লড়ছি। কিন্তু এ বারের মতো স্বতঃস্ফূর্ততা আগে দেখিনি। জোট ঘিরে মানুষের কী উৎসাহ! একটা কেন্দ্র বলে বলছি না। এই স্বতঃস্ফূর্ততা এ বার সরকার বদলে দিতে পারে।’’
ঠেকে শিখে নিজেকেই এ বার বদলে নিয়েছেন তুলনায় অনভিজ্ঞ এক প্রার্থী। উপনির্বাচনে চৌরঙ্গিতে হইহই করে প্রচার করেছিলেন বিজেপি-র রীতেশ তিওয়ারি। এ বার গেরুয়া ঝান্ডার পালে সেই হাওয়া নেই, রীতেশও বাড়ি বাড়ি যাওয়া আর ছোট জমায়েতের উপরে নজর দিয়েছেন। তাঁর দাবি, ‘‘তৃণমূল দুর্নীতিগ্রস্ত। আর কংগ্রেসের ডিএনএ-তেও দুর্নীতি আছে। সিপিএম যে এখন গণতন্ত্র ফেরাতে জোটের কথা বলছে, তাদের ৩৪ বছরের রাজত্বে কেমন গণতন্ত্র ছিল? আমরা যখন এই কথাগুলো বলছি, মানুষ সমর্থন করছেন।’’
যুক্তি, দাবি-পাল্টা দাবির মধ্যে অঙ্কের হিসাব যাঁরা করবেন, তাঁদের মাথায় রাখতে হবে প্রায় ২৬% সংখ্যালঘু ভোটের কথাও। লোকসভা ভোটে একটু এ ধার-ও ধার হয়েছে দেখে গত বছর পুরভোটে ৬২, ৬৩ নম্বর ওয়ার্ডের মতো এলাকায় সব সাফ করে দিয়েছিল ইকবাল আহমেদের বাহিনী! ইকবালের কন্যা সানা আহমেদ একটা ওয়ার্ড থেকেই লিড নিয়েছিলেন ২০ হাজারের বেশি! সেই ইকবাল যিনি নারদ নিউজের প্রতিনিধিকে ফিরহাদ হাকিম, শোভন চট্টোপাধ্যায়দের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন, তাঁর বাহিনী কি আবার একই খেল দেখাবে? সোমেন, রীতেশদের আশা, ও জিনিস আর হবে না। আর নয়না বলছেন, তৃণমূল এমনিই জিতবে!
কিন্তু জোটের জোর সঙ্গে নিয়ে বিপক্ষে সোমেন কি তাঁর জন্য বাড়তি চাপ? নয়না বোঝাচ্ছেন, ‘‘এখানে টর্চ নিয়ে এক জন দাঁড়িয়েছেন, তিনিও আমার প্রতিপক্ষ। ভোট মানে লড়াই আর লড়াইয়ে সব প্রতিপক্ষকেই গুরুত্ব দিচ্ছি।’’ সাংসদ সুদীপের যুক্তি,
নাম দিয়ে কী হবে? ভোটটা এ বার কাজে হবে!
কাজের ঢাক যত জোরে পারছেন, বাজাচ্ছেন সুদীপ-নয়না। রকমসকম দেখে বিসর্জনের কথা মনে পড়ে গেলে কী আর করা যাবে!