ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ির সাহুডাঙ্গিতে জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী। শুক্রবার বিশ্বরূপ বসাকের তোলা ছবি।
তাঁর বাইশ গজে আবার বিরোধী পক্ষ সেই নির্বাচন কমিশন।
২০১৩ সালে পঞ্চায়েত ভোট, পরের বছর লোকসভা নির্বাচনের সময় দেখা গিয়েছে, সুষ্ঠু অবাধ ভোট করতে চাওয়া কমিশনকে বিরোধী পক্ষ ঠাউরে নেন তৃণমূল নেত্রী। এ বারও বাংলার ভোটমঞ্চে একই দৃশ্য। নিরপেক্ষ ভোট করাতে নেমে সদ্য বৃহস্পতিবারই কমিশন এক লপ্তে ৩৭ জন অফিসারকে বদলি করেছে। তার পর ২৪ ঘণ্টাও কাটেনি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আক্রমণের নিশানায় তারা। শুক্রবার ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ির সভায় দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘‘নির্বাচন কমিশন পাঠিয়ে দিল্লি আমাকে অপমান করেছে।’’ এবং কমিশনের সিদ্ধান্তকে কার্যত চ্যালেঞ্জ করেন, ‘‘পুলিশকে বদলি করে কোনও লাভ নেই। যাঁকে তাদের জায়গায় দেবেন, তাঁরাও তো আমাদেরই লোক!’’
এক দিকে জোটের চাপ, অন্য দিকে নারদের হুল। তার সঙ্গে নির্বাচন কমিশন এ বারে যে সব বেনজির এবং কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করেছে অবাধ ভোটের স্বার্থে, তা তৃণমূল নেত্রীর রক্তচাপ বাড়িয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট বলেই মনে করছেন বিরোধীদের একটা বড় অংশ। সাহুডাঙ্গির এ দিনের সভায় হাজির অনেকেরও একই মত। তাঁরা বলছেন, এ দিন হেলিকপ্টার থেকে নামার পরে মঞ্চে থাকার পুরো সময়টাই মুখ্যমন্ত্রীকে তাঁর স্বাভাবিক মেজাজে পাওয়া যায়নি। কখনও খেই হারিয়ে ওবামার পুলিশকে ডেকে ভোট করানোর কথা বলেছেন। কখনও বলেছেন, ওদের আমেরিকা থেকে ট্রেনে চাপিয়ে আনুন, রাজ্য ভাড়া দিয়ে দেবে। এর মধ্যে মধ্যেই ধেয়ে এসেছে কমিশনের প্রতি আক্রমণ।
নির্বাচন কমিশনই বিধানসভা ভোটের দায়িত্বে থাকে, এ কথা রাজনীতিতে যার হাতেখড়ি হয়েছে, সে-ও জানে। তা হলে দিল্লি পাঠিয়েছে বলে কী বোঝাতে চেয়েছেন মমতা? তৃণমূলের স্থানীয় নেতারাও এই নিয়ে এক গলা জলে। তবে মমতার ঘনিষ্ঠ কারও কারও বক্তব্য, উনি আসলে এটাকে দিল্লির রাজনৈতিক চক্রান্ত বলতে চেয়েছেন। সেই চক্রান্তে বিজেপির সঙ্গে সিপিএম, কংগ্রেসও রয়েছে— এটাও বোঝাতে চেয়েছেন তাঁর বক্তৃতায়। তাই কখনও বলেছেন, ‘‘কমিশনকে দেখে মনে হচ্ছে, তারা সিপিএমের হয়ে ভোটটাও দিয়ে দেবে।’’ কখনও বলেছেন, ‘‘যে সব জায়গায় বদলি হয়েছে, দেখে নিন। কোনওটায় সিপিএম লড়ছে। কোনওটায় বিজেপি। কোনওটায় কংগ্রেস।’’
ক্ষমতায় আসার পরে মমতা প্রথম বড় নির্বাচনের মুখোমুখি হয়েছিলেন ২০১৩ সালে, পঞ্চায়েত ভোটে। সে বার কেন্দ্রীয় বাহিনীর তত্ত্বাবধানে ভোট করা নিয়ে তৎকালীন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডের সঙ্গে পা়ঞ্জা কষতে সুপ্রিম কোর্ট অবধি যায় রাজ্য সরকার। শেষে হেরেও যায়। এর এক বছর পরে লোকসভা ভোটের প্রথম দিকে জাতীয় নির্বাচন কমিশন কঠোর পদক্ষেপ করা শুরু করলে ময়দানে নেমে তাদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার শুরু করেছিলেন মমতা। রাজ্য প্রশাসন সূত্রের খবর, তৎকালীন মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রকে এই নিয়ে রাজ্যের তরফে বিবৃতি পর্যন্ত দিতে বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। ওই সূত্রই জানাচ্ছে, সে সময় সঞ্জয়বাবুই বেঁকে বসেন এবং মুখ্যমন্ত্রীকে বোঝান, কমিশনের মতো সাংবিধানিক সংস্থার বিরুদ্ধে এমন জেহাদ সম্ভব নয়।
শুক্রবার মমতা কিন্তু আগের মতোই লাগামছাড়া। পুলিশ-প্রশাসনে বদলির কথা জানার পরে মমতার ঘনিষ্ঠ এক নেতা বৃহস্পতিবার বলেছিলেন, ‘‘যাঁদের আনা হল, তাঁরাও তো এই সরকারেরই অফিসার!’’ একই কথা এ দিন শোনা গেল খোদ নেত্রীর মুখে। যা শুনে বিরোধীদের প্রশ্ন, তা হলে কি মুখ্যমন্ত্রী মেনে নিলেন, তাঁর প্রশাসন সত্যিই নিরপেক্ষ নয়! এ দিন মমতা আরও বলেন, ‘‘ভোটের পরে আবার আমাদের হাতেই ক্ষমতা আসবে। তখন কমিশন কী করবে?’’ এই কথার মধ্যেও বদলি বা সরিয়ে দেওয়াদের ফেরানোর ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছেন বিরোধীরা। তাঁদের বক্তব্য, ‘‘লোকসভা ভোটের আগেও এমন কথা বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। আর ভোট হওয়ার পরপরই সৈয়দ মহম্মদ হুসেন মির্জা এবং ভারতী ঘোষকে তাঁদের জায়গায় ফিরিয়ে আনেন।’’ এর পরে তাঁদের কটাক্ষ, ‘‘সৈয়দ মির্জা তাঁর নিজের লোক কি না, সেটা তো এখন নারদ স্টিং অপারেশন থেকেই স্পষ্ট!’’
কমিশনের বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রীর এই বিষোদ্গার নিয়ে কমিশনেরই দ্বারস্থ হচ্ছে সিপিএম। দলের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি এ দিন জানিয়েছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী কমিশনকে বারবার চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন। আমরা এ বিষয়ে ওঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। আরও যে সব অফিসার পুরোপুরি শাসক দলের হয়ে কাজ করছেন, তাঁদেরও গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সরানোর দাবি করছি।’’
কমিশনের কোপে যে আরও অফিসার পড়তে পারেন, সে ইঙ্গিত অবশ্য এ দিনই কমিশন সূত্রে মিলেছে। পাশাপাশি পাঁচ রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিককে পর্যবেক্ষক হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের ময়দানে নজরদারির জন্য নামিয়ে দিচ্ছে তারা। বৃহস্পতিবারই এই ঘোষণা করেছিল কমিশন। শুক্রবার দুপুরের পরে সেই সব বিশেষ দলের প্রতিনিধিরা রাজ্যে আসতে শুরু করেন। এ দিন যাঁরা এসেছেন, সব প্রশ্নে তাঁরা একটাই জবাব দিয়েছেন, রাজ্যে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভোট করানোই তাঁদের মূল লক্ষ্য। এ দিনই নির্বাচন কমিশন থেকে এক বিবৃতিতে জানান হয়েছে, রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী অফিসার এবং জেলা নির্বাচনী আধিকারিকদের সঙ্গে আলোচনা করেই এই বিশেষ পাঁচটি দল কাজ করবে।